মানুষের জন্ম হলে তার রেকর্ড সরকারি খাতায় লিপিবদ্ধ করাই হল জন্ম নিবন্ধন। এখন অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করা যায় খুব সহজেই৷
একজন মানুষের জন্য তার জন্য সরকারিভাবে নিবন্ধিত থাকাটা খুব জরুরী বিষয়। কোন নতুন মানুষের জন্ম হলে তার রেকর্ড সরকারি খাতায় লিপিবদ্ধ করাই হল জন্ম নিবন্ধন। বাংলাদেশ ২০০৪ সালে জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই জন্ম নিবন্ধন করা জরুরি। যে কোন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কেই এটা করে নিতে হবে।
কেননা, জন্ম নিবন্ধন না করা হলে এর অভাবের কারণে বিভিন্ন সময় সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে।
একজন মানুষের জন্য জন্ম নিবন্ধন হলো তার প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিভিন্ন কাজের জন্য জন্ম নিবন্ধন লাগে।
আমাদের আজকের জানার বিষয় হল কিভাবে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করবেন এ সম্পর্কে। তো চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাকঃ
জন্ম নিবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আমরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়েছি অনেকে। একজন মানুষ জন্মের পর পরই ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়ে যায় না।
সেজন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এর মাঝে বিভিন্ন কারণে সরকারি একটা পরিচয় এর প্রয়োজন পড়ে যায়। আর এই প্রয়োজন পূরণের জন্য জন্ম নিবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এটি হলো একজন মানুষের জন্য প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এ জন্য যেসব ক্ষেত্রে একজন মানুষের দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হয়; সেক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন দেখাতে হয় যাদের কাছে কোন আইডি কার্ড নেই।
২০০৬ সাল এর প্রণীত আইন অনুযায়ী একজন শিশুকে তার জন্য ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করতে হবে।
এটা বাধ্যতামূলক। যদি দুই বছরের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন না করা হয় সেক্ষেত্রে জরিমানা দেয়া লাগে।
এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তাই নানাবিধ গুরুত্ব বিবেচনায় আপনার জন্ম নিবন্ধন করাটা জরুরী একটি বিষয়। তাই এই বিষয়ে আপনি কেন অবহেলা করবেন?
কতগুলো পদ্ধতিতে জন্ম নিবন্ধন করা যায়?
সাধারণত, দুই পদ্ধতিতে জন্ম নিবন্ধন করা যায়। একটি হল অনলাইন পদ্ধতিতে আর আরেকটি হলো অফলাইন পদ্ধতিতে। জন্ম নিবন্ধন এর আইন প্রণয়ন হওয়ার পর মানুষ অফলাইনে বেশি নিবন্ধন করেছিল।
তবে বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন করার প্রতি মানুষ বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু এখনো মানুষ অফলাইনে জন্ম নিবন্ধন করে থাকে।
আমাদের আজকের জানার বিষয় হল কিভাবে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করবো? ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া গুলো আমরা আজকে জানবো ইনশা আল্লাহ্।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধের নিয়ম
দিন দিন অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন এর পরিমাণ বাড়ছে। কেননা, অফলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে পরিশ্রম বেশী হয়। কিন্তু অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া তুলনামূলক নির্ভেজাল।
নিজে কার্যালয়ে হাজির হয়ে জন্ম নিবন্ধন করার চেয়ে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করাটাই বেশি সহজ ও রিকমেন্ডেড।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে হলে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে স্টেপ বাই স্টেপ কাজ করতে হবে।
ধারাবাহিকভাবে সে ধাপগুলো নিচে উল্লেখ করছিঃ
প্রথম ধাপ
নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার জন্য https://bdris.gov.bd/ এই সাইটটিতে প্রবেশ করুন।
দ্বিতীয় ধাপ
ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করার পর ঠিকানা দিতে হবে। বর্তমান ঠিকানা অথবা স্থায়ী ঠিকানা নির্বাচন করা যেতে পারে।
আবেদনকারী যে কার্যালয় থেকে জন্ম নিবন্ধন করতে চান সেটি সিলেক্ট করে নিতে হবে।
শিশু যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে বাংলাদেশ দূতাবাস সিলেক্ট করতে হবে। এখান থেকেই জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেয়া হয়ে থাকে এক্ষেত্রে।
তৃতীয় ধাপ
উপরের দুটি কাজ যথাক্রমে শেষ করার পর আপনাকে ফরম ফিলাপ করতে হবে। এ ধাপটি সাবধানে কমপ্লিট করতে হবে।
ফরমে আবেদনকারীর নাম বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখতে হবে। ইংরেজিতে লেখার ক্ষেত্রে সব অক্ষর বড় হাতের দিতে হবে।
এরপর জন্মতারিখ, বাবা-মা এর কততম সন্তান, জন্মস্থান – এসব তথ্য দিয়ে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে।
চতুর্থ ধাপ
পরবর্তী ধাপে রয়েছে আরেকটি ফরম। এখানে বিভিন্ন তথ্য আরও দিতে হবে। সেগুলো হলো – পিতার নাম ইংরেজি ও বাংলাতে লেখা, পিতার জন্ম সনদের নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এবং জাতীয়তা কি সেটা লিখতে হবে।
অনুরূপভাবে মাতার তথ্যগুলো দিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখবেন, নামের স্পেলিং বা বানান যেন ঠিক থাকে।
নাহলে পরবর্তীতে সমস্যায় পড়ে যেতে পারেন। একাজগুলো ঠিকমতো হলে পঞ্চম ধাপে যেতে পরবর্তী বাটনে ক্লিক করুন।
পঞ্চম ধাপ
এই ধাপে আপনার সঠিক বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা লিখতে হবে। যদি বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ভিন্ন হয়ে থাকে,
তাহলে সতর্কতার সাথে লিখুন। আর একই ঠিকানা দুই ক্ষেত্রে হয়ে থাকলে হুবহু একই তথ্য রাখুন।
ষষ্ঠ ধাপ
এই ধাপে যার জন্য জন্ম নিবন্ধন করা হচ্ছে তার তথ্য দিতে হবে। আবেদনকারীর বয়স ১৮ এর বেশি হলে নিজেই এই কাজগুলো করা যায়। তবে বয়স ১৮ এর কম হলে অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে করবেন।
সপ্তম ধাপ
এই হলো রিভিউ করার ধাপ। যে সমস্ত তথ্যগুলো টাইপ করা হয়েছে, সেগুলো মনোযোগ দিয়ে চেক করে নিন। তাড়াহুড়ো করবেন না। সব কিছু চেক করা হলে সাবমিট করে দিন।
অষ্টম ধাপ
আবেদন সঠিকভাবে দাখিল হলে একটি আবেতন নম্বর পেয়ে যাবেন। এই নম্বর দিয়ে জন্ম নিবন্ধন এর প্রক্রিয়ার খবরাখবর বা আপডেট জানা যায়।
তাই এ নম্বরটি সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য আপনাকে এই পেজটি প্রিন্ট করে নিতে হবে।
উপরোক্ত আটটি ধাপের কাজ হয়ে গেলে আবেদনপত্রটির প্রিন্ট কপি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে স্থানীয় কার্যালয়ে।
আবেদন করার ১৫ দিন পর জমা দিবেন। তাহলে সহজে এবং দ্রুতই জন্ম নিবন্ধন পেয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ্।
যা আপনার জেনে রাখা জরুরী
কোন শিশুর জন্মের পর ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের জন্য কোন টাকা লাগে না। কিন্তু ৪৫ দিন ওভার হয়ে গেলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি জমা দিয়ে তারপর আবেদন করতে হয়।
আর দেশের বাইরে থেকে জন্ম নিবন্ধন করতে হলে, সেটার জন্য সর্বোচ্চ দুই মার্কিন ডলারের মতো খরচ পড়তে পারে।
বাংলাদেশে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগ ছিল যা বর্তমানে প্রযোজ্য নয়।
শিশুর বয়স ৪৫ দিন অতিক্রম হলেই ফি দিতে হয় এখন। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা আপনার জেনে রাখা জরুরি। তা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ
- যাদের জাতীয় পরিচয় পত্র নেই তাদেরকে পাসপোর্ট করতে হলে জন্ম নিবন্ধন লাগবে। যারা পাসপোর্ট করতে চাচ্ছেন এই কাজ অগ্রসর হওয়ার পূর্বে দ্রুত জন্ম নিবন্ধন করে নিন।
- করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আবেদন করতে হয়। তবে যারা স্টুডেন্ট এবং এনআইডি কার্ড নেই; তারা জন্ম নিবন্ধন দিয়ে ভ্যাকসিন নিবন্ধন করতে পারে।
- একজন মানুষ সর্বোচ্চ একবার বৈধ ভাবে জন্ম নিবন্ধন করতে পারে। একাধিকবার জন্ম নিবন্ধন করা দন্ডনীয় অপরাধ।
তাই কেউ যদি ভুলবশত একাধিকবার নিবন্ধন করে থাকে; তাহলে ডুপ্লিকেট আবেদনটি যত দ্রুত সম্ভব বাতিল করতে হবে।
- মেয়েদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য কোন ক্রমেই স্বামীর নাম ব্যবহার করা যাবে না। তাদের জন্ম নিবন্ধন তাদের পিতা-মাতার নামে করতে হবে।
- মেয়েদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে তাদের স্বামীর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা যাবে না; বরং বিয়ের আগের ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে।
- বাংলাদেশি কোন নাগরিকের শিশু যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করে থাকে তবুও তার জন্ম নিবন্ধন করা যাবে। এজন্য ব্যবস্থা আছে।
- অফলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার প্রক্রিয়াকে অনলাইনে করা তুলনামূলক বেশি সহজ ও কম ঝামেলাপূর্ণ।
- ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি এর নতুন প্রণীত নিয়ম অনুযায়ী যাদের জন্ম ২০০১ সালের পর তাদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন লাগবে।
তবে যাদের জন্ম ২০০১ এর আগে হয়েছে তারা পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়েও জন্ম নিবন্ধন করতে পারবে।
যারা এখনো জন্ম নিবন্ধন করেননি, তাদের জন্য এই আর্টিকেল উপকারী হবে ইনশা আল্লাহ্। সঠিক এবং নির্ভুল ভাবে জন্ম নিবন্ধন করা প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য খুব জরুরী।
তাই যাদের জন্ম নিবন্ধন করা প্রয়োজন, তারা উপরোক্ত নিয়মগুলো অনুসরণ করে জন্ম নিবন্ধন করে ফেলতে পারেন।