যে প্রক্রিয়ায় কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কর্মীদের কাজে উৎসাহিত, প্ররোচিত ও অনুপ্রাণিত করা হয় তাকে প্রেষণা বলে। ব্যবস্থাপনা হলো কর্মীদের দ্বারা কাজ করিয়ে নেয়ার একটি কৌশল বিশেষ। তাই আধুনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রেষণার গুরুত্ব সর্বাধিক। প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের নিকট থেকে কাজ আদায় করিয়ে নিতে হলে অবশ্যই তাদের মাঝে কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। কেননা, কাজের প্রতি আগ্রহ বা ইচ্ছা না থাকলে কোন কর্মীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যতই থাকুক না কেন তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন সম্ভব নয়। তাই ব্যবস্থাপনাকে যথাযথ প্রেষণা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে কর্মীদের কাজে ইচ্ছা ও আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। কোন একটি কার্য সম্পাদনে কর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করার মনস্তাত্ত্বিক কৌশলকে প্রেষণা বলে অভিহিত করা হয় ।
নিম্নে ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞগণ প্রদত্ত প্রেষণার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
Prof. Weihrich 4 Koontz, “Motivation is a general term applying to the entire class of drives, desires, needs, wishes, and similar forces.” অর্থাৎ, প্রেষণা হলো এমন একটি সাধারণ বিষয় যা নকল প্রকারের তাড়না, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, ইচ্ছা এবং একই ধরনের শক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় ।
R. Terry Franklin 43, “Motivation is the need or drive within an individual that Arrives him or her towards goal-oriented action.” অর্থাৎ, প্রেষণা হলো কোন ব্যক্তির মধ্যে চাহিদা বা তাড়না জাগ্রত হওয়া যা তাকে লক্ষ্যভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণের দিকে তাড়িত করে।
Prof. R. W. Griffin এর মতে, “Motivation is the set of forces that cause people to behave in certain ways.” অর্থাৎ, প্রেষণা হলো এরূপ শক্তিসমূহের প্রতিষ্ঠা যার কারণে মানুষ সুনির্দিষ্ট পন্থায় তাদের আচরণকে পরিচালিত করে।
vancevich, Donnelly Gibson, “Motivation may be defined as the state of an individual’s perspective which represents the strength of his or her propensity to exert effort towards some particular behavior.” অর্থাৎ, প্রেষণা হচ্ছে কোন ব্যক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি অবস্থা যা তাঁর প্রবণতাকে সামর্থ্য দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করে যাতে কোন বিশেষ আচরণের দিকে প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করা যায় ।
P. Robbins ও Coulter এর মতে, “Motivation is the willingness to exert high levels fort to reach organizational goals, conditioned by the effort’s ability to satisfy some individualed.” অর্থাৎ, প্রেষণা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উচ্চ পর্যায়ের প্রচেষ্টা গ্রহণের ইচ্ছা যা কতিপয় ব্যক্তিগত হিদা পূরণের সামর্থ্যকে প্রচেষ্টা দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়।
নিম্নোক্তভাবে একটি প্রেষণা মডেল দাঁড় করানো যেতে পারে :
প্রেষণার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদেরকে কার্যসম্পাদনে উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করার জন্য প্রেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আধুনিক ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের মতো প্রেষণা কার্যেরও কতিপয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এসব বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করা হলো :
১. মনস্তাত্ত্বিক বিষয় (Psychological issue) : প্রেষণা একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় যা ব্যক্তির ভেতর থেকে আসে। একজন ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অনুভূতি তার চাহিদা ও কর্ম আচরণকে প্রভাবিত করে। সেজন্য কর্মীদের অধিকমাত্রায় প্রণোদিত করার জন্য তাদের আবেগ অনুভূতিকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হয়।
২. অবিরাম প্রক্রিয়া (Continuous process) : মানুষের চাহিদা অফুরন্ত। সে কারণে একটি চাহিদা পূরণ হবার সাথে সাথে অপর একটি চাহিদা তার সামনে হাজির হয়। কাজেই কর্মীদের একবার বা দুবারের জন্য প্রেষণা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা যায় না। ব্যবস্থাপনাকে তাই প্রেষণার কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হয় ।
৩. ব্যক্তি আচরণের চালকশক্তি (Drive force of human behaviour) : প্রেষণা হচ্ছে ব্যক্তি আচরণের চালকশক্তি। গাড়ীর ইঞ্জিন যেমন গাড়ীকে সামনে অগ্রগামী হবার শক্তি জোগায়, তেমনি প্রেষণার ব্যক্তিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জোগায়। প্রেষণার অভাবে ব্যক্তি উদ্যমহীন হয়ে পড়ে এবং তার কর্মপ্রেরণা লোপ পায়।
৪. লক্ষ্যকেন্দ্রিক (Goal oriented) : প্রেষণা হচ্ছে লক্ষ্য কেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রেষণা কার্যক্রম গৃহীত হয়ে থাকে। প্রেষণা কর্মীদের কাজে আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করে।
৫. মনোবল উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন (Main support of moral development) : কর্মপরিবেশে দীর্ঘসময় কাজ করতে করতে শ্রমিক কর্মীরা ক্লান্তি ও একঘেয়েমি অনুভব করে। ফলে কাজের প্রতি কর্মীদের আগ্রহ কমে যায়। প্রেষণা কর্মীদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এবং মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয়বোধ জাগিয়ে তোলে। এতে কর্মী মনোবল উন্নত হয় এবং তাদের কার্যসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়।
আরো কিছু প্রেষণার বৈশিষ্ট্য
৬. ব্যবস্থাপনা কার্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ (Essential part of management function) : প্রেষণা ব্যবস্থাপনা কার্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যবস্থাপনার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো কর্মীদের কাছ থেকে কৌশলে কাজ আদায় করে নেওয়া। আধুনিক ব্যবস্থাপনা দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে কর্মীদের নিকট থেকে জোর করে কাজ আদায় করা যায় না। তাদের নিকট থেকে ভাল কাজ পেতে হলে তাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হয়। এ কাজে আর্থিক অনার্থিক বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
৭. অভাব বা চাহিদা প্রেষণার ভিত্তি (Need or want is the basis of motivation) : অভাব বা চাহিদা মানুষের কর্ম প্রেরণার উৎস। মানুষ কাজের মাধ্যমে তার অভাব পূরণে সক্ষম হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা মানুষের অভাব বা চাহিদা মিটিয়ে তাদেরকে কর্মে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কাজেই প্রেষণার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানুষের অভাববোধ বা চাহিদা।
৮. প্রেষণার ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হতে পারে (Motivation may be positive or negative) : প্রেষণার ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে কোন ধরনের হতে পারে। ইতিবাচক প্রেষণা প্রশংসা, পুরস্কার, স্বীকৃতি ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট। আর নেতিবাচক প্রেষণা বল প্রয়োগ, ভয় ভীতি প্রদর্শন, বদলি, পদোন্নতি, বেতন হ্রাস ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট।
৯. সামগ্রিক প্রেষণা (Full motivation) : প্রত্যেক ব্যক্তি একটি সুসংগঠিত সমগ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কাজেই ব্যক্তির অংশবিশেষকে প্রেষিত করা যায় না। প্রেষণার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হয়।
১০. হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির প্রেষণা (Motivation for frustrated person) : মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে কোন মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে প্রেষণাদান করা যায় না।
পরিশেষে, এই ছিলো প্রেষণা কাকে বলে এবং প্রেষণার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু তথ্য। যা আপনাকে বুজতে সাহায্য করবে উক্ত বিষয় গুলো এবং তার আলোকে যেকোনো কাজে প্রেষণার মাধ্যমে পরিচালিত হতে। আরো জানুন মোটিভেশন বা প্রেষণার তত্ব গুলো সম্পর্কে।