আপনি কি নিজ উদ্দ্যোগে স্ট্রবেরি চাষ করতে চান? তবে কিভাবে শুরু করবেন সঠিক নিয়ম জানেন না তবে এই আর্টিকেল আপনার জন্য কারন এখানে জানাবো স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে এবং উক্ত বিষয়ের সাথে যুক্ত খুঁটিনাটি সকল তথ্য। তবে প্রথমেই জেনে নেয়া যাক কেনো স্ট্রবেরি চাষ করা উচিৎ সেই সম্পর্কে।
কেনো করবেন স্ট্রবেরি চাষ ?
খুব সহজে এবং সল্প স্থানেই শুরু করা যায় স্ট্রবেরি চাষ। আধুনিক এই চাষ ব্যবসাটি শুরু করছেন তাদের পুরোনো চাষাবাদ বাদ দিয়ে, কিন্তু কেনো? কেনো অনেক কৃষকরা ঝুলছেন স্ট্রবেরি চাষের দিকে? প্রশ্নটি যদি নিজেকেই নিজেক করে থাকেন তবে আমরা জানাবো কেনো করবেন স্ট্রবেরি করবেন সেই সম্পর্কে।
প্রথমেই যে কারনটিকে মূখ্য বলে গণ্য করবো সেটা হলো, “স্ট্রবেরির উৎপাদন কম, অপরদিকে উপকারিতার কারনে এই ফলটির চাহিদা খুব বেশি” এবং যেখানে চাহিদা বেশি সেখানে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি।
অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ট্রবেরি কেবল একটি ফলই নয় বরং একটি ঔষধী উপাদানও। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপকারিতা যা পরের ধাপে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। তাছাড়া স্ট্রবেরি চাষ করতে খরচের মাত্রা খুব কম থাকে বিধায় যেকেউ চাইলে স্ট্রবেরি চাষ শুরু করতে পারেন। এবার এক নজরে দেখে নেই স্ট্রবেরি ফলের উপকারিতা সমূহ।
স্ট্রবেরি ফলের উপকারিতা
স্ট্রবেরিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, এবং উল্লেখ্য করার মত রয়েছে ভিটামিন – এ, সি, কে এবং মিনারেল যা দেহের প্রচুর পরিমাণের উপকৃত করে। স্ট্রবেরিতে রয়েছে প্রচুর পানি ও অল্প পরিমাণের কার্বোহাইড্রেট যার ফলে ওজন কমানোর জন্য সাহায্য করে।
স্ট্রবেরিতে থাকা ছোট ছোট বীজ গুলোতে থাকে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস যার ফলে মানুষের হার্ড ভালো থাকে। তাছাড়া এই ফল খাওয়ার মাধ্যমে দাত ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়। স্ট্রবেরি ক্যান্সার ঠেকাতে কার্যকর কারন এটি ফ্রির্যাডিকালস নিয়ন্ত্রনে রাখে।
তাছাড়া আরো বেশি বেশি উপকার সম্পর্কে জানতে চাইলে গুগল সার্চের মাধ্যমে জেনে নিতে পারেন, কারন আমরা এবার সরাসরি চলে যাবো স্ট্রবেরি চাষ করার পদ্ধতিতে যা ছিলো আমাদের মূল টপিক।
কিভাবে শুরু করা যায় স্ট্রবেরি চাষ?
খুব সহজে অল্প জায়গা ও সল্প পুজি নিয়েই আপনি স্ট্রবেরি চাষ এর কাজ শুরু করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার প্রথমেই বেশ কিছু ব্যাপারে জেনে নিতে হবে সেগুলো হলো:
- স্ট্রবেরির জাত
- পরিবেশ
- মাটি ও চারা
- পরিচর্চার প্রক্রিয়া
- যথাযথ সার প্রয়োগ ও ফল সংগ্রহ
আপনার যদি এই বিষয় গুলোর সম্পর্কে ভালো ধারনা থেকে থাকে তবে আপনি খুব সহজেই স্ট্রবেরি চাষ করতে পারবেন। জানানো এই পুরো ব্যাপার গুলো নিয়ে বিস্তারিত যেখানে ধাপ অনুযায়ী থাকবে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত (ধাপে ধাপে)
স্ট্রবেরির জাত সমূহ
বাংলাদেশের পরিবেশ অনুযায়ী দেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মতে উচ্চফলনশীল ৩ টি জাতের খোজ পেয়েছে যেগুলো হলো – বারি স্ট্রবেরি-১, বারি স্ট্রবেরি-২ ও বারি স্ট্রবেরি-৩। এবার কিছু আলোচনা করা যাক জাত গুলো সম্পর্কে।
বারি স্ট্রবেরি – ১ : এই জাতের স্ট্রবেরি দেশের সকল স্থানে হয়ে থাকে। এটির সময়কাল নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত। ফল হয় টকটকে লাল ও আকর্ষনীয় বটে।
বারি স্ট্রবেরি – ২ : আমেরিকার ফ্লোরিডা নামক স্থান থেকে বাংলাদেশে আগত এই জাতের পাতা আসা শুরু হয় ডিসেম্বরের শুরুতে এবং ফল দেয় প্রায় মার্চ অব্দি।
বারি স্ট্রবেরি – ৩ : উক্ত জাতের গাছের ফুল আসা শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ও এপ্রিল মাস অব্দি টকটকে লাল রঙ্গের স্ট্রবেরি প্রদান করে থাকে। ফলটি প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ২০ টন ধারন করে থাকে।
মাটি, আবহাওয়া ও সময়
স্ট্রবেরি ফল সবচেয়ে ভালো হয় শুস্ক স্থানে। যে দেশ গুলোতে শীত কালের সময়কাল দীর্ঘ সেখানে এই ফল ভালো ফলন হয়ে থাকে। এবং উক্ত ফল চাষের জন্য বেলে মাটি সর্বোত্তম হয়ে থাকে। পাশাপাশি মাটির জমি যদি একটু উচু স্থানে হয়ে থাকে সেই বিষয়ে রাখতে হবে কঠিন নজরদারী। সাধারণত পানি জমে থাকা স্থানে স্ট্রবেরি জম্মে থাকে না।
জমি তৈরি করে চারা রোপন
স্ট্রবেরি চাষ করার জন্য উক্ত জমিকে একাধিকবার ভালো ভাবে মই দিয়ে চাষের জন্য প্রস্তুত করতে হবে পাশাপাশি সকল ধরনের আগাছা গুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে চারা রোপনের ১৫ দিন আগে ৩০ গ্রাম (প্রতি শতাংশ জমির জন্য) ব্লিচিং পাউডার জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
সমতল মাটিতে চাষ করা যায় তবে সবচেয়ে ভালো হয় বেড তৈরি করা হলে। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উচু ও ১ মিটার প্রস্ত বেড তৈরি করতে হবে। চারা রোপনের ক্ষেত্রে এক চারা থেকে অন্য চারার দুরুত্ব হতে হবে ২০ – ৪০ সেন্টিমিটার এবং এক বেড থেকে আরেক বেডের দুরুত্ব হবে ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার।
বাংলাদেশের পেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর স্ট্রবেরি চারা রোপনের জন্য উপযুক্ত সময় হলেও তা ডিসেম্বর অব্দি দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে।
সারের ব্যবহার
ভালো ফলনের আশা করে থাকলে স্ট্রবেরি চাষের জন্য নিয়মিত এবং যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে সার প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে এক্ষেত্রে জমিতে হেক্টরপ্রতি ৩০ টন পচা গোবর, ২৫০ কেজি ইউরিয়া, ১৭৫ কেজি টিএসপি, ২০০ কেজি এমওপি, ১১৫ কেজি জিপসাম, ১২ কেজি বরিক এসিড ও ৮ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করার নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে।
তাছাড়া চারা রোপনের ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর ৫ থেকে ৮ কিস্তিতে পানির সেচের সাথে ২০০ কেজি ইউরিয়া ও ১৫০ কেজি এমওপি সার মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা
প্রথময় স্ট্রবেরি গাছ জমে থাকা পানি সহ্য করতে পারে না তাই বৃষ্টির পানি হোক না কৃত্তিম উপায়ে সেচ দেয়া পানি হোক তা যেন নিস্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যদিক যদি গাছের রসের অভাব দেখা দেয় তবে অবশ্যই সেচের ব্যবস্থা করা উচিৎ।
অনেক ক্ষেত্রে পানির নলের সাহায্যে ফোটায় ফোটায় গাছের গোড়ায় পানি প্রদান করা হয় এতে করে অতিরিক্ত পানি জমে থাকার মত কোনো চান্সই থাকে না এবং গাছ যথাসময়ে বেড়ে উঠতে সক্ষম হয়।
ঝোপ তৈরি ও পরিচর্চা
স্ট্রবেরি চাষ করার ক্ষেত্রে পরিচর্চার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন মাটির সংস্পর্শে আসলেই স্ট্রবেরি পচে যায়। যখন চারা রোপন করবেন তার ২০ দিনের মাথায় খড় দিয়ে সেগুলোকে ভালো ভাবে ঢেকে দিতে হবে। তাছাড়া পোকামাকড় থেকে বাচতে প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ মিলিলিটার ডার্সবান ২০ ইসি ও ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ডিএফ মিশিয়ে ওই দ্রবণে খড় সুধন করে নিলেই উঁইপোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
স্ট্রবেরির রোগ ও প্রতিকার
এই ফলটিতে বেশ কিছু রোগ দেখা দেয় যার মধ্যে অন্যতম গুলো হচ্ছে – পাতায় দাগ পড়ার রোগ, এটার ফলে পাতায় বাদামী রঙ্গের দাগ দেখা যায়। এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
তাছাড়া “ফল পচা রোগ” নামক এক রোগেরও দেখা মিলে স্ট্রবেরি ফলের মধ্যে। কিছুটা বাদামী ও কালো রঙের ছোপ ছোপ দাগ হয়ে যায় ফলের মধ্যে। এর প্রতিরোধে ফল পরিপক্ব হওয়ার পূর্বে নোইন ৫০ ডব্লিওপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গাছের রক্ষণাবেক্ষণ
যেহেতু স্ট্রবেরি গাছ পানি বা ভাড়ি বর্ষণ সহ্য করতে পারে না তাই মার্চ – এপ্রিল মাস অব্দি ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া যখন ফল আহরণ করা হবে তখন মাতৃ গাছকে আলাদা ভাবে কোনো টবে বা পলিথিন ছাউনির নিচে নিয়ে আসতে হবে এতে করে ভারি বর্ষন হলেও সে থাকে গাছকে রক্ষা করা যাবে।
যেহেতু স্ট্রবেরি গাছের প্রচুর লতা বের হয় এবং পরবর্তীতে সেটা জমির সব টুকু জুড়ে বিসৃত হয় তাই এর কারনে ফলনে ভালো ফল পাওয়া যায় না। তাই লতা বের হলে সেটা খড় বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া ভালো ফলনের জন্য হরমোন পাতায় স্প্রে করে দিলে ভালো হয়।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষন করার উপায়
বিক্রি করার জন্য ফল পুরোপুরি পাকার প্রয়োজন নেই, যখন কাচা ফল হাল্কা হলদে বা লালচে রঙ দিতে শুরু করবে তখনই বুঝা যাবে ফল পাকা শুরু করেছে এবং তখন তোলা যায়। খেয়াল রাখতে হবে ফল যেনো বোটা সহ তোলা যায়। এবং বাজারজাতকরণের সময় কাগজের মোড়ক ব্যবহার করা উচিৎ।
–
টবে স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি
আপনি যদি নিজ বাসার ছাদে টবে স্ট্রবেরি চাষ করতে চান তবে প্রথমেই কোনো নার্সারি থেকে চারা ক্রয় করে আনতে হবে এক্ষেত্রে একেক টি চারার দাম পড়তে পারে ৩০ টাকার মতন। তারপর ৫ লিটার পানির ড্রাম কেটে টবের মত বানিয়ে সেখানে চারা রোপন করতে পারেন।
মাটির সঙ্গে ব্যবহার করুন গোবর, তাছাড়া রান্নার পর থাকা বর্জ যেমন সবজির খোসা, পচা পাতা মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি ঝুর ঝুর করে নিতে হবে। শীতকালে রাতে শিশির পড়ে এমন স্থানে রাখা খুব দরকার। এতে স্ট্রবেরির ফলন ভালো হয়। তাছাড়া পরিচর্চার বাকি প্রসেস গুলো উপরে উল্লেখিত নিয়মের অনুসারেই করে ফেলুন।
আর্টিকেল থেকে যা শিখলেন
উক্ত আর্টিকেলে জানিয়েছি স্ট্রবেরি ফল পদ্ধতি সম্পর্কে এবং স্ট্রবেরি চাষ করতে যাবতীয় যেসব জিনিস প্রয়োজন হয় সেগুলো বিস্তারিত তুলে ধরেছি। তাছাড়া কেনো করবেন স্ট্রবেরি চাষ এবং স্ট্রবেরির উপকারিতা সম্পর্কেও জানানো হয়েছে। সর্বশেষে বলা যায়, উক্ত আর্টিকেলে স্ট্রবেরি চাষ সম্পর্কে যাবতীয় যা তথ্য প্রদান করা যায় তার সকল গুলোই দেয়া হয়েছে। আপনি যদি চাষাবাদে ইচ্ছুক হোন তবে দেখতে পারেন বাংলা আলো ওয়েবসাইটের কৃষি ক্যাটাগরিটি।