আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতু। মহান আল্লাহ্ তাআলার যাবতীয় প্রশংসা। দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর। যিনি মানুষকে মুক্তির পথে দাওয়াত দিয়েছেন। যার জীবনীতে রয়েছে আমাদের জন্য হিদায়াত। আমাদের আজকের জানার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো – অসুস্থ অবস্থায় নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে। এ সম্পর্কে আজ আমরা বিস্তারিত জানবো ইনশা আল্লাহ।
নামাজ হলো দ্বীন ইসলামের খুঁটি। নামাজ ছাড়া মানুষ মুসলিম থাকতে পারেনা। বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ।
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দিবে, সে কুফরি করবে। বিষয়টা অত্যন্ত ভয়াবহ। আমাদেরকে সুস্থ অবস্থায় এমনকি অসুস্থ অবস্থায়ও নামাজ অবশ্যই পড়তে হবে। অসুস্থ অবস্থায় নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক ভুল-ভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়।
সেগুলো শুধরে সঠিক পন্থায় কিভাবে নামাজ অসুস্থ অবস্থায় আদায় করা যায় – এ বিষয়ে সঠিক গাইডলাইন সহীহ্ সুন্নাহর আলোকে জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
অসুস্থ অবস্থায় নামাজ পড়ার নিয়ম
দলিল সমূহ
আমাদেরকে একথা মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ্ তাআলা দ্বীন ইসলামকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র ক্বুরআনুল কারীমে বলেন, “দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি।” (সূরা আল – হাজ্বঃ আয়াত – ৭৮)
মহান আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন, “আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না।” (সূরা আল – বাক্বারাহ্ঃ আয়াত – ১৮৫)
অপর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন, “অতএব, তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর এবং শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো।” (সূরা আত – তাগাবুনঃ আয়াত – ১৬)
ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি আবু হুরাইরা রাদ্বিআল্লহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় দীন সহজ।” (সহীহ্ বুখারি, হাদীস নম্বর – ৩৯)
উপর্যুক্ত দলিল থেকে এই নীতিমালা জানা যায়, মহান আল্লাহ্ অসুস্থ ব্যক্তির জন্য তার রোগের কারণে ইবাদাতকে হালকা করে দিয়েছেন। যাতে অসুস্থ ব্যক্তি কোনপ্রকার কষ্ট ও কাঠিন্যতা ছাড়াই সহজে ইবাদাত-বন্দেগী করতে সমর্থ হয়।
তায়াম্মুম
অসুস্থ ব্যক্তি নামাজের জন্য প্রথমে উযূ করবে। যদি উযূ করার কারণে রোগবৃদ্ধির প্রবল আশঙ্কা থাকে ও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তায়াম্মুম করবে।
তায়াম্মুমের নিয়ম হলো – মনে মনে তায়াম্মুম করার নিয়ত করে দুই হাত পবিত্র মাটিতে একবার মারবে। অতঃপর চেহারা ও তারপর দুই হাত কব্জিসহ মাসাহ্ করবে। রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তি নিজে তায়াম্মুম করতে না পারলে অন্য ব্যা্তি তাকে তায়াম্মুম করিয়ে দিতে পারবে। (শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল – উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ্)
শারীরিক দুর্বলতা
মনে রাখতে হবে যে, অসুস্থ ব্যক্তির জন্যও নামাজ দাড়িয়ে আদায় করা ফরয। তবে, যদি সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে বাঁকানো বা ঝুঁকে দাঁড়ানো অবস্থায় নামাজ পড়বে।
দাঁড়িয়ে নামাজ করতে সমর্থ না হলে বসে নামাজ আদায় করবে। এক্ষেত্রে দাঁড়ানো ও রূকু করার সময় চার জানু হয়ে বসবে। সিজদাহর সময় পা বিছিয়ে পায়ের গোছার ওপর বসবে, যেভাবে আমরা তাশাহহুদের জন্য বৈঠকে বসি।
অসুস্থ ব্যক্তি যদি বসেো নামাজ পড়ার মতো অবস্থায় না থাকে, তাহলে এক পার্শ্বে কাত হয়ে ক্বিবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়বে। বাম পার্শ্ব হতে ডান পার্শ্বে কাত হয়ে নামাজ আদায় করা উত্তম।
যদি ক্বিবলামুখী হওয়া সম্ভব না হয়, তবে যেভাবে সম্ভব যেদিকে মুখ করে সম্ভব সেভাবে নামাজ পড়বে। এই নামাজ অসুস্থ ব্যক্তিকে পরে পুনরায় পড়তে হবে না।
যদি পার্শ্বে কাত হয়ে নামাজ পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে দুই পা ক্বিবলামুখী করে চিৎ হয়ে শুয়ে নামাজ পড়তে হবে। বালিশ বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে মাথা কিছুটা উঁচু করে দিতে হবে। যদি উঁচু করা সম্ভব না হয়, তবে সেভাবেই সে অবস্থাতে অসুস্থ ব্যক্তি নামাজ পড়বে। এ নামাজ পরে পুনরায় পড়তে হবে না।
অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রূকু ও সিজদাহ করা ফরয। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে রূকু ও সিজদাহর সময় মাথা দিয়ে ইশা করবে। রূকু অপেক্ষা সিজদাহতে বেশি ঝুঁকবে।
যদি এমন হয় যে, অসুস্থ ব্যক্তি রূকু করতে সক্ষম কিন্তু সিজদাহ করতে সক্ষম নয়, তাহলে সে রূকু করবে ও সিজদাহর সময় ইশারা করবে। আর যদি অসুস্থ ব্যক্তি সিজদাহ করতে সক্ষম, কিন্তু রূকু করতে অক্ষম হয়, তাহলে রূকুর সময় ইশারা করবে ও সিজদাহর সময় সিজদাহ করবে।
প্রচন্ড শারীরিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে
যদি রূকু ও সিজদাহর সময় মাথা দিয়ে ইশালা করা সম্ভব না হয়, তাহলে দুই চোখের পাতা দিয়ে ইশারা করবে। এক্ষেত্রে চোখের পাতা রুকূর ক্ষেত্রে কম, সিজদাহর ক্ষেত্রে বেশি বন্ধ করবে। অনেক অসুস্থ ব্যক্তি নামাজে হাতের আঙুল ত্বারা ইশারা করে থাকেন – এটা ভুল।
হাতের আঙুল দ্বারা ইশারা করে রূকু – সিজদাহ করার পক্ষে কোন দলিল ক্বুরআন ও সুন্নাহতে পাওয়া যায় না। আর এর সপক্ষে কোন আলেমের বক্তব্যও পাওয়া যায়না। (শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল – উসাইমীন)
যদি মাথা ও চোখ দিয়ে নামাজ পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দিয়ে নামাজ পড়তে হবে। অন্তর দিয়ে ক্বিয়াম, রূকু ও সিজদাহর নিয়ত করতে হবে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়ত করে।
উপর্যুক্ত নিয়ম অনুসারে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য প্রত্যেক নামাজ ওয়াক্তমতো পড়া ফরয। দেরী করে পড়া বৈধ নয়। তবে, প্রত্যেক ওয়াক্তে নামাজ পড়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হলে যোহর-আসর ও মাগরিব-এশা একত্রে জমা করে পড়া যাবে।
তবে ফজরের নামাজকে তার আগের এশা অথবা তার পরের যোহরের নামাজের সাথে একত্রে জমা করে পড়া যাবে না। ফজরের নামাজ ফজরের ওয়াক্তেই আদায় করতে হবে।
অসুস্থ অবস্থায় নামাজ পড়ার নিয়ম না জানায় অনেকে যে ভুল করে
যিনি অসুস্থ, নামাজ পড়ার সময় তিনি বালিশ বা এ জাতীয় কোন কিছুতে সিজদাহ দিয়ে থাকেন। এটা ভুল কাজ। এমনভাবে সিজদাহ করা শুদ্ধ ও সঠিক নয়। বরং ইশারায় স্বাভাবিকভাবেই কোনকিছু ছাড়া সিজদাহ করতে হবে আমাদেরকে।
রোগীর যদি উঠাবসা করতে সমস্যা হয় তাহলে বসে সালাত আদায় করতে হবে। বসেও কষ্ট হলে শুয়ে সালাত আদায় করতে হবে এবং ইশারায় রুকু-সেজদায় করতে হবে। বসে সালাত আদায় করার সময় টেবিল, বালিশ বা অন্য কিছুর উপর সেজদা করা ঠিক নয়। কেননা এ মর্মে হাদিস বর্ণিত হয়েছে,
জাবির রাদ্বিআল্লহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রোগীকে দেখা-শোনা করতে গেলে দেখেলেন, সে ব্যক্তি বালিশের উপর সিজদাহ করছে। তখন তিনি সেটা নিয়ে ফেলে দিলেন।
তারপর সে ব্যক্তি একখণ্ড কাঠ নিয়ে তার উপর সেজাদা করলে তিনি সেটা নিয়েও ফেলে দিলেন এবং বললেন,
صلِّ على الأرضِ إن استطعت ، وإلا فأوم إيماءً ، واجعل سجودَك أخفضَ من
ركوعِك
“যদি পারো মাটিতে সালাত আদায় করবে অন্যথায় ইশার করবে। আর সিজদাহকে রুকু থেকে বেশি নিচু করবে।” [সিলসিলা সহীহাহ/ হা/৩২৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিআল্লহু আনহু এর বর্ণনায় রয়েছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বালিশের উপর সেজদাহ করতে নিষেধ করেছেন।’
এ মর্মে আরও একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং, অসুস্থ ব্যক্তি সিজদাহ করার সময় টেবিল, কাঠ বা বালিশ ব্যবহার করবে না। বরং ইশারায় রুকু-সিজদাহ করবে।
আমরা আজকে অসুস্থ ব্যক্তির নামাজের নিয়ম বিস্তারিত জানলাম। এত কিছু দ্বারা এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নামাজ কোন অবস্থাতেই ত্যাগ করা যাবেই না। যেকোন মূল্যে নামাজ আমাদেরকে পড়তে হবে। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তাওফীক তান করুন। আমীন।