–
আপনি কি রক্তশূণ্যতায় ভুগছেন? রক্তশূণ্যতা বা অ্যানিমিয়া দূর করার উপায় সম্পর্কে জানতে এবং যথাপযোগী ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে রক্তশূন্যতা দূর করতে চান? তবে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্যই। কেননা এখানে আলোচনা করা হয়েছে রক্তশূন্যতা সংক্রান্ত লক্ষণ, কারন, প্রতিরোধ এবং উক্ত সমস্যা সমাধানে গ্রহনযোগ্য খাদ্যভাস সম্পর্কে। তাই পুরো আর্টিকেলটি অধ্যায়ন করুন এবং রক্তশূণ্যতা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান ঘটান।
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা কি ও কেনো হয়?
অ্যানিমিয়া এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা থাকে না, যা একজন ব্যক্তিকে ক্লান্ত এবং দুর্বল বোধ করতে পারে। অ্যানিমিয়া একটি খুব সাধারণ স্বাস্থ্যগত অবস্থা যা প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু উভয়কেই ক্ষেত্রেই দেখা দিতে পারে। এটি লাল রক্ত কোষের অভাবের কারণে ঘটে থাকে যা সারা শরীরে অক্সিজেন বহন করে।
পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা ছাড়া, শরীর তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পেতে পারে না, যার ফলে ক্লান্তি বোধ, ফ্যাকাশে ভাব এবং শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরনের রক্তাল্পতা রয়েছে, যার প্রত্যেকটির নিজস্ব কারণ এবং লক্ষণ রয়েছে, যার মধ্যে খাদ্যে আয়রনের অভাব, কিছু চিকিৎসা শর্ত এবং কিছু ওষুধ রয়েছে। আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা খাদ্যে আয়রনের অভাব বা রক্তপাতের কারণে হয়, অন্যদিকে ক্ষতিকর রক্তাল্পতা ভিটামিন বি 12 এর অভাবের কারণে হয়।
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যানিমিয়া নির্ণয় করা যায়। যাকে বলা হয় complete blood count (CBC) যা শরীরের লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা পরিমাপ করে। রক্তাল্পতার চিকিত্সার মধ্যে আয়রন সম্পূরক গ্রহণ, আরও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া বা ভিটামিন বি 12 সম্পূরক গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সা পরিকল্পনার জন্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা সর্বদা ভাল। তবে উক্ত আর্টিকেলে রক্ত অ্যানিমিয়া দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে যেখান এর লক্ষণ, কারণ, উৎস সহ এর প্রতিরোধ স,পর্কে জানানো হবে।
দেহে রক্তশূণ্যতার ফলে যে সকল সমস্যা দেখা দেয়
আপনি ইতিমধ্যে জানেন যে – অ্যানিমিয়া এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা থাকে না। এটি বেশ কয়েকটি উপসর্গের কারণ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
১) ক্লান্তি বা দুর্বলতা: পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা ছাড়া আপনার শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এটি আপনাকে ক্লান্ত বা দুর্বল বোধ করতে পারে।
২) ফ্যাকাশে ত্বক: অ্যানিমিয়ার কারনে আপনার ত্বককে ফ্যাকাশে বা হলুদ দেখাতে পারে।
৩) শ্বাসকষ্ট: আপনার শরীরের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছাড়া আপনি শ্বাস নিতে পারবেন না, উক্ত বিষয়টি আপনাকে শ্বাসকষ্ট সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি করবে।
৪) হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া: আপনার শরীরে যদি পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা না থাকে তবে এটি আপনার হৃদস্পন্দন দ্রুত করে দিতে পারে যা যেকোনো মানুষের জন্যই ক্ষতিকর।
৫) মাথাব্যথা: রক্তাল্পতা মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরার কারন হতে পারে।
৬) ঠান্ডা হাত ও পা: আমরা জানি রক্ত সাধারনত গরম হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা বা রক্ত না থাকে তবে আপনার শরীরে আপনার হাত ও পা গরম রাখতে সমস্যা হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, এখানে বলে দেয়া উপসর্গগুলি অন্যান্য শারীরিক অবস্থার কারণেও হতে পারে, তাই আপনি যদি এই উপসর্গগুলির মধ্যে কোনোটি অনুভব করেন তবে সঠিক নির্ণয়ের জন্য একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করা জরুরি।
রক্তশূণ্যতা বা অ্যানিমিয়ার লক্ষণ
শরীরে রক্তশূণ্যতার দেখা দিলে বেশ কিছু উপসর্গ লক্ষনীয় হয়। নিম্মে এমন সম্ভব্য লক্ষণগুলির মধ্যে কিছু উপস্থাপন করা হলো:
- ক্লান্তি,
- দুর্বলতা,
- ফ্যাকাশে হওয়া,
- শ্বাসকষ্ট,
- দ্রুত হৃদস্পন্দন,
- মাথা ঘোরা বা হালকা মাথাব্যথা,
- মাথাব্যথা, ঠান্ডা হাত ও পা,
- বিরক্তি এবং
- মনোযোগ দিতে অসুবিধা
গুরুতর ক্ষেত্রে, রক্তাল্পতা বুকে ব্যথা, জন্ডিস এবং বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। শরীরে আয়রন, ফোলেট বা ভিটামিন বি 12 এর অভাবের কারণে অ্যানিমিয়া হয়। এই ঘাটতিগুলি একটি খারাপ ডায়েট, রক্তের ক্ষয় বা নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা অবস্থার কারণে হতে পারে।
রক্তশূণ্যতা বা অ্যানিমিয়ার কারণ সমূহ
বিভিন্ন কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি বা রক্তশূণ্যতা হতে পারে। রক্তাল্পতার কিছু কারণ নিয়ে নিম্মে ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো:
- রক্তক্ষরণ: ভারী মাসিক, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তপাত বা আঘাতের কারণে হতে পারে।
- পুষ্টির ঘাটতি: খাবারে আয়রন, ভিটামিন বি 12 বা ফোলেটের অভাবের কারণে অ্যানিমিয়া হতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী রোগ: কিডনি রোগ, ক্যান্সার এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো অবস্থার কারণে রক্তাল্পতা হতে পারে।
- অস্থি মজ্জার ব্যাধি: কিছু অস্থি মজ্জার ব্যাধি, যেমন লিউকেমিয়া এবং মাইলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমগুলি রক্তাল্পতার কারণ হতে পারে।
- ওষুধ: কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যানিমিয়া হতে পারে, যেমন ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ (NSAIDs)।
- গর্ভাবস্থা: রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ভ্রূণের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া সাধারণ।
রক্তশূণ্যতা বা অ্যানিমিয়া দূর করার উপায়
এই পর্যায়ে জানাবো ঠিক কি করলে শরীরের রক্তশূন্যতা দূর করা সম্ভব। যার মধ্যে রয়েছে কিছু খাদ্য, কিছু করনীয় বিষয়। একেক করে বিষয় গুলো জেনে নিন।
১) বেশি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া: রক্তাল্পতার চিকিত্সার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির মধ্যে একটি হল আপনার আয়রন গ্রহণ বৃদ্ধি করা। হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য আয়রন অপরিহার্য, লোহিত রক্তকণিকার প্রোটিন যা অক্সিজেন বহন করে। মাংস, হাঁস-মুরগি, মাছ, ডিম, লেবু, বাদাম এবং গাঢ় সবুজ শাক-সবজির মতো খাবারই আয়রনের ভালো উৎস। আপনি আয়রন সাপ্লিমেন্টও নিতে পারেন, তবে এটি করার আগে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।
২) ভিটামিন বি-১২ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন: ভিটামিন বি 12 লাল রক্ত কণিকা উৎপাদনের জন্য আরেকটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এটি মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত খাবার এবং ডিমের মতো খাবারে পাওয়া যায়। আপনি যদি আপনার খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ভিটামিন বি-১২ না পান তবে আপনাকে একটি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।
৩) ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার খান: প্রশ্ন হচ্ছে, “ফোলেট কি?” ফোলেট হল এক ধরনের ভিটামিন বি যা শরীররে সুস্থ লাল রক্ত কণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে। গাঢ় সবুজ শাক-সবজি, লেবু এবং সাইট্রাস ফল সবই ফোলেটের প্রধান উৎস।
৪) অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন: অ্যালকোহল শরীরের আয়রন শোষণ করার ক্ষমতাতে ব্যহত করতে পারে, তাই আপনার রক্তশূন্যতা থাকলে এটি এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
৫) নিয়মিত ব্যায়াম করুন: ব্যায়াম লোহিত রক্ত কণিকার উৎপাদন বাড়াতে এবং সঞ্চালন উন্নত করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
৬) পর্যাপ্ত ঘুম দিন: পর্যাপ্ত ঘুম পাওয়া শরীরের লোহিত রক্তকণিকা তৈরির জন্য অপরিহার্য। একজন প্রাপ্ত বয়স্কের লোকের প্রতি রাতে ৭-৯ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে।
৭) ইপসন লবন: অনেকেই এটির নাম শুনেন নি হয়তো, কিন্তু আপনি যদি আধা বালতি পানিতে ২ চামচ ইপসম লবণ মিশিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ মিনিট পা ডুবিয়ে রাখেন তবে এটি রক্তশূণ্যতা দূরীকরণে কার্যকর হবে।
৮) তাছাড়া হাত পা ম্যাসাজ করা যেতে পারে, কেননা এতে রক্ত চলাচর সঠিক ভাবে হয়ে থাকে।
এই টিপসগুলি অনুসরণ করে রক্তশূণ্যতার সমস্যা দূর করতে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেন।
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূণ্যতা হলে যে খাবার গুলো খেতে হবে
- অ্যানিমিয়া বাংলাদেশে একটি সাধারণ অবস্থা যা খাদ্যে আয়রন, ভিটামিন বি 12 বা ফোলেটের অভাবের কারণে ঘটে। একটি সুষম খাদ্য খাওয়া যাতে নির্দিষ্ট কিছু খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে এই পুষ্টির মাত্রা বাড়াতে এবং রক্তাল্পতা নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে।
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: মাছ, যেমন ইলিশ এবং রুই, আয়রনের উৎকৃষ্ট উৎস এবং বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়। মাংস, মুরগি এবং ডিমও ভালো উৎস। লোহার নিরামিষ উত্সের মধ্যে রয়েছে শাক-সবুজ শাকসবজি, যেমন পালং শাক এবং আমলা, সেইসাথে মসুর এবং ছোলা।
- ফোলেট-সমৃদ্ধ খাবার: পালং শাক, ওকড়া এবং আমলা হল ফোলেটের উৎকৃষ্ট উৎস এবং সাধারণত বাংলাদেশে খাওয়া হয়। অন্যান্য ভাল উত্সগুলির মধ্যে রয়েছে সাইট্রাস ফল, যেমন কমলা এবং লেবু এবং শক্তিশালী শস্য।
- ভিটামিন বি 12 সমৃদ্ধ খাবার: পশু-ভিত্তিক খাবার যেমন মাংস, মাছ, মুরগি, ডিম এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য ভিটামিন বি 12 সমৃদ্ধ।
- হিম আয়রন: লাল মাংস, হাঁস-মুরগি এবং মাছে পাওয়া হিম আয়রন উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারে পাওয়া নন-হিম আয়রনের চেয়ে শরীর দ্বারা ভালভাবে শোষিত হয়।
- প্রতিদিন একটি পাকা কলার সাথে মধু মিশিয়ে ২ বেলা খেতে পারেন, কারন এখানে অনেক পরিমাণের আয়ডিন পাওয়া যায়।
গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য
এই ছিলো অ্যানিমিয়া দূর করার উপায় বা রক্তশূন্যতা দূর করার ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য যেখানে আলোকপাত করা হয়েছে রক্তশূণ্যতা কি, কেনো হয়, এটির লক্ষণ ও কারন সমূহ পাশাপাশি উক্ত সমস্যার সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়েও বিস্তারিত ধারনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া আপনি যদি রক্ত সংক্রান্ত অন্যান্য অসুবিধার সমাধান যেমন – উচ্চ রক্তচাপ, নিন্ম রক্তচাপ সম্পর্কে জানতে চান তবে উক্ত লিংকে ক্লিক করে জেনে নিতে পারেন। বাংলা আলো ওয়েবসাইটের স্বাস্থ্য টিপস ক্যাটাগরিতে প্রতিনিয়ত এমন উপকারী কন্টেন্ট দেয়া হয়ে থাকে।