আসসালামু ‘আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলার অশেষ মেহেরবানী তে সবাই ভাল আছেন। আমরা মুসলিমরা প্রতি রামাযানে রোজা রাখি এবং ইফতার করি। ইফতারের আগে আমল ও দোয়া রয়েছে; যা হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা। সে বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের এই আর্টিকেল।
আমরা যার আনুগত্য এবং অনুসরণ করতে আদিষ্ট; তিনি হলেন নাবী মুহাম্মদ (সঃ)। তিনি আমাদেরকে প্রতিটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাই আমাদেরকে সেই বিশুদ্ধ দিকনির্দেশনা বাস্তব জীবনে মেনে চলতে হবে আর এতেই কল্যান নিহিত রয়েছে।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো রামাযানের রোজা রাখার পর কি করণীয়; রাসূল (সঃ) সেই দিকনির্দেশনাও আমাদের দিয়ে গেছেন। ইফতারের বিশুদ্ধ আমল ও দোয়া রয়েছে। এছাড়া রোজা অবস্থায় আপনি একা একা নিজ মাতৃভাষায়ও দুআ করতে পারেন। তবে সম্মিলিত দোয়া করা জায়েয নেই।
বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা ইফতারের আগে আমল ও দোয়া সাব্যস্ত হয়েছে। তো চলুন সেগুলো দলিলসহ জেনে নিইঃ
ইফতারের সুন্নাহ্সম্মত আমল ও দোয়া
সহিহ্ বুখারীতে এসেছে –
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকেরা যতদিন শীঘ্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। (সহিহ্ বুখারী, মুসলিম ১৩/৯, হাঃ ১০৯৮, আহমাদ ২২৮২৮)
সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইফতারের সাথে আযানের সম্পর্ক নেই, বরং ইফতার সূর্যাস্তের সাথে সম্পর্কিত। হাদীসে জলদি জলদি ইফতার করার জন্য খুব তাগিদ দেয়া হয়েছে। কেননা, দ্রুত ইফতার করায় কল্যাণ রয়েছে, যা দেরিতে করার মধ্যে নেই।
এর অর্থ হচ্ছে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হবে। চোখে সূর্যাস্ত দেখে ইফতার করা যায়। সূর্যাস্ত দেখতে না পাওয়া গেলে সূর্যাস্তের সময়সূচী বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস থেকে সংগ্রহ করা যায়। অথবা আপনার ফোন থেকে “Sunset Here” লিখে গুগল সার্চ দিলে সঠিক সূর্যাস্তের সময় পেয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ্।
রেডিও ও টেলিভিশনে সূর্যাস্তের সময় ঘোষণা করা হয়, খবরের কাগজেও সূর্যাস্তের সময় লেখা হয়। আমাদের দেশে ইফতারের সময়সূচী প্রকাশ করা হয়- যেগুলিতে সূর্যাস্তের সময়ের সাথে ১ মিনিট বা ২/৩ মিনিট বা ৫ মিনিট যোগ করে ইফতারের সময় বলে লেখা হয়। বিশেষ করে ৩ মিনিট দেরি করা হয়; যা একদম অনুচিত।
কিন্তু হাদীসে উল্লেখিত কল্যাণ লাভ করতে চাইলে সূর্যাস্তের সময় জেনে নিয়ে সাথে সাথেই ইফতার করতে হবে। সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও ইফতার না করে বসে বসে অন্ধকার করা ইহুদী ও নাসারাদের কাজ। (আবূ দাউদ ২২৫৩, ইবনু মাজাহ ১৬৯৮ এবং হাদিসের মান সহিহ্)
ইফতারের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ পাঠ করা সুন্নত। তাই ইফতারের খাবার খাওয়ার শুরুতে আপনাকে ‘বিসমিল্লাহ্’ পাঠ করতে হবে। এটি খুব সহজ একটি আমল। ইফতার সহ যে কোনও খাবার বা পানীয় গ্রহণের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি) পাঠ করা সুন্নত।
হাদিসে এসেছে, মা আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ طَعَاماً فَلْيَقُلْ بِسْمِ اللَّهِ، فَإِنْ نَسِيَ فِي أَوَّلِهِ فَلْيَقُلْ بسمِ اللَّهِ فِي أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ
“তোমাদের কেউ যখন খাওয়া শুরু করে, সে যেন বলে, বিসমিল্লাহ (অর্থ: আল্লাহর নামে শুরু করছি) আর যদি, শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলতে ভুলে যায় তাহলে সে যেন বলে: “বিসমিল্লাহি ফী আওয়ালিহী ওয়া আখিরিহী” (অর্থ: শুরুতে ও শেষে আল্লাহর নামে) [সুনানে আবু দাউদ-হিসনুল মুসলিম]
অন্য বর্ণনায় এসেছে:
بِسْمِ اللَّه أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ
উচ্চারণ: “বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু”(আবু দাউদ)
অর্থ: শুরু ও শেষে আল্লাহর নামে।
ইফতারের সময় “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু …” পাঠ করার হাদিস দুর্বল:
اللَّهُمَّ لَكَ صُمتُ وعلَى رزقِكَ أفطَرتُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আ’লা রিযক্বিকা আফত্বারতু।
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি।”
এ হাদিসটি অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে দুর্বল বা যঈফ। নিম্নে এ বিষয়ে কয়েকজন মুহাদ্দিসগণের অভিমত পেশ করা হল:
- ইবনে হাজার আল আসক্বালানি (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেছেন, إسناده ضعيف” এর সনদ দুর্বল বা যঈফ। [আত তালখিসুল হাবির ২/৮০২]
- ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেছেন, لا يثبت “এ হাদিসটি সাব্যস্ত নয়।” [যাদুল মাআদ: ২/৪৯]
- শাওকানি বলেছেন, إسناده ضعيف এর সনদ দুর্বল। [নাইলুল আওত্বার-৪/৩০১]
- বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস শাইখ আলবানি বলেছেন, এটি দুর্বল। [যঈফ আবু দাউদ, হা/২৩৫৮]
যদিও কোনও কোনও আলেম বলেন, এর সনদ শাওয়াহেদ (বা একাধিক সাক্ষ্য হাদিস) দ্বারা শক্তিশালী হয়। যেমনটি আব্দুল কাদের আরনাবুত ইমাম নওবীর ‘আল আযকার’ গ্রন্থের তাহকিক গ্রন্থে এ কথা বলেছেন। তবে এই হাদিস যঈফ বা দুর্বল হওয়ার পক্ষেই অধিকাংশ আলেমের অভিমত। সুতরাং যঈফ হাদিস পরিত্যাগ করে আমাদেরকে বিশুদ্ধ হাদিস আমল করতে হবে।
তাহলে ইফতারের পর কোন দোয়া পড়বেন? নিম্নোক্ত দুআটি পড়া সুন্নতঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন:
“ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ”
উচ্চারণ: “যাহাবায যামাউ ওয়াব তাল্লাতিল উরূক্বু ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ।”
অর্থ: “তৃষ্ণা দূর হয়েছে; শিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং প্রতিদান সাব্যস্ত হয়েছে ইনশাআল্লাহ”।
[সুনানে আবু দাউদ, আলবানি রহ. হাদিসটিকে সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থ (২০৬৬) ‘হাসান’ বলেছেন]। শাইখ উসাইমিন রাহ. বলেন, “এ দুআটি ইফতারের পরে পাঠযোগ্য। সুতরাং এই মাসনূন ইফতারের আগে আমল ও দোয়া আমাদের সবাইকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে অর্থসহ শিখে আমল করা উচিত।
ইফতারের সাথে সংশ্লিষ্ট সুন্নাহ্সম্মত আমল এবং দোয়াগুলো আমরা শিখে নিবো ইনশা আল্লাহ্। বিশুদ্ধ আরবিতে দোয়া গুলো পড়বেন এবং অর্থ বুঝে পড়বেন। তাহলে ইফতারের আগে আমল ও দোয়া এর মাধ্যমে সওয়াব এবং প্রতিদান পাবেন ইনশা আল্লাহ্।
মহান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে তার প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (সঃ) এর সুন্নাহর অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন, আমাদের সিয়াম কবুল করুন এবং উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।