ড্রাগন ফল : চাষ পদ্ধতি, খরচ ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত | বাংলা আলো 

0
115
ড্রাগন-ফল-চাষ-পদ্ধতি

স্বাদে মজাদার, দেখতে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো ফল হচ্ছে ড্রাগন ফল। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে জন্মানো এই ফলটি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাষাবাদ হচ্ছে।

 

ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি, খরচ ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়েই আমাদের আজকের এই আলোচনাটি।

 

কম্বোডিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং ভারত সহ অনেক দেশেই এই ফল চাষাবাদ হয়ে থাকে। সেসব দেশে এই ফলের বেশ ভাল চাহিদা রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও এই ফলের চাহিদা রয়েছে এবং দিনদিন এই ফলের চাষাবাদও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে এই ফলের বিভিন্ন জাত আনা হয়। এই গাছে কোন পাতা থাকে না। 

আমাদের দেশে লাল রঙের ড্রাগন ফল বিক্রয় হতে দেখা যায়। এই ফলের চাষ পদ্ধতি, খরচ এবং উপকারিতা সম্পর্কে চলুন জেনে নিইঃ

ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি

 

আমাদের বাংলাদেশের ভূমি ড্রাগন ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া এদেশের আবহাওয়াও এই ফল চাষাবাদ করার জন্য উপযুক্ত। ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি জানার পূর্বে এই ফলের প্রজাতি সম্পর্কে জেনে রাখা জরুরি।

 

সাধারণত, ড্রাগন ফল ৩ প্রজাতির হয়ে থাকে। সেগুলো হলোঃ

 

১। কোস্টারিকা ড্রাগন ফল

২। লাল ড্রাগন ফল এবং

৩। হলুদ রঙের ড্রাগন ফল

 

কোস্টারিকা ড্রাগন ফল এর বাইরের খোসা এবং শাঁস – উভয়ের রঙই লাল হয়ে থাকে। লাল ড্রাগন ফলের খোসা লাল হলেও এর শাঁস সাদা বর্ণের হয়। আর হলুদ বর্ণের ড্রাগন ফল এর খোসা হলুদ হয় এবং শাঁস সাদা রঙের হয়ে থাকে।

ড্রাগন ফলের জাত

 

আমাদের দেশে লাল রঙের ড্রাগন ফল বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ড্রাগন ফলের জাতগুলো হলোঃ বাউ ড্রাগন ফল -১, বাউ ড্রাগন ফল – ২, বাউ ড্রাগন ফল – ৩ সহ অন্যান্য জাত।

চাষের জমি প্রস্তুত ও চাষের সময়

 

ড্রাগন ফল চাষের জন্য প্রথমে দরকার এর জন্য উপযুক্ত ভূমি। দুই তিনটি চাষ করার মাধ্যমে জমি প্রস্তুত করতে হয়। পানি জমে থাকে না – এমন উঁচু এবং মাঝারি উঁচু উর্বর ভূমি এ ফল চাষের জন্য উপযুক্ত। পাহাড়ি  ঢালু ধরনের জমিও ড্রাগন ফল চাষের জন্য উপযুক্ত।

 

এই জমি প্রস্তুত করার জন্য কয়েকটি চাষ দেয়ার পরে মই দিতে হবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় হলো ড্রাগন ফল চাষের উপযুক্ত সময়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর – অক্টোবর এর মধ্যবর্তী সময়ে ফলগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়।

রোপন পদ্ধতি এবং বংশবিস্তার

 

ড্রাগন ফল হলো দীর্ঘমেয়াদি একটি ফসল। একটি গাছ হতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর ফলন পাওয়া যায়। সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা ষঢ়ভুজাকার পদ্ধতিতে এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে ড্রাগন ফলের কাটিং রোপণ করতে হয়। ড্রাগন ফল রোপণের জন্য উপযোগী সময় হলো মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য অক্টোবর।

 

এই ফল এক বিঘা জমিতে সমান্তরালে ১২-১৪ ইঞ্চি ফাঁকা করে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা যায়; যার ফলে এ পদ্ধতিতে রোপণে খরচ তুলনামূলক কম। এক বিঘাতে প্রায় ১৪৫০ টির মতো চারা রোপণ করা সম্ভব।

 

ড্রাগন ফল সাধারণত বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। কিন্তু এর গুণাগুণ বজায় রেখে ফল উৎপাদনের জ্য কাটিং বা অঙ্গজ পদ্ধতি অনুসরণ করা উত্তম। 

 

কাটিং থেকে ফল ধরতে প্রায় এক থেকে দেড় বছরের মতো সময় লাগে। বেলে দোআঁশ মাটিতে ড্রাগন ফলের কাটিং রোপন করতে হয়।

 

গোঁড়ার দিকের কাঁটা অংশ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে পুঁততে হয় আর সেখান থেকে চারা উৎপন্ন হয়ে থাকে। একমাসের মধ্যেই সাধারণত চারা মূল জমিতে রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। কাটিংকৃত কলম সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করার মাধ্যমে সহজে বংশবিস্তার করা যায়।

প্রুনিং ও ট্রেনিং

 

ড্রাগন ফলের গাছগুলো সাধারণত দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং শাখাগুলো মোটা হয়। গাছের বয়স যত বাড়ে, এর শাখা প্রশাখাও তত বাড়ে। একটি ড্রাগন ফলের গাছে বয়সভেদে ৩০ থেকে একশোর অধিক প্রশাখা হয়ে থাকে।

 

তাই গাছকে প্রুনিং ও ট্রেনিং করতে হয় আর এটা মাঝদুপুরে করা উত্তম। প্রুনিং হলো ছাঁটাই করা আর ট্রেনিং হলো গাছকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করা। ড্রাগন ফল এর গাছকে প্রুনিং ও ট্রেনিং করার পর ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়।

চারা রোপন ও পরিচর্যা

 

প্রথমে আপনাকে জমিতে চারা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হাদাক মিশিয়ে স্প্রে করে নিতে হবে। এরপর ৩ মিটার পরপর গর্ত করে সেখানে বিভিন্ন রকমের সার দিয়ে মাটি ভরাট করে এবং প্রয়োজনে ওলটপালট করে মাটি তৈরি করতে হবে।

 

আপনি কেমন জমিতে কেমনভাবে বাগান করতে চান, সে অনুযায়ী আপনাকে বুঝেশুনে চারা রোপণ করতে হবে। এক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিয়ে কাজ করা উত্তম। চারা রোপণ করার পর অল্প সময়েই ড্রাগন গাছ বেড়ে উঠতে থাকে।

 

এজন্য রোপণের ২ মাস পর গাছের কাণ্ড বাঁশের সাথে বেঁধে দিতে হবে সোজাভাবে। গাছ আরও বড় হলে আড়াআড়িভাবে বাঁশ ও রড একসাথে করে গাছগুলোর শাখা প্রশাখাগুলো বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে হবে। ঝুলন্ত শাখায় ফল বেশি ধরে।

 

অনেকে গোল টায়ার দ্বারা গাছের মাথা ও ডগা ঝুলিয়ে গাছের পরিচর্যার কাজ করে থাকেন, কিন্তু সেই নিয়মে সাধারণত খরচ তুলনামূলক বেশি পড়ে। তবে আপনি সে নিয়মেও করতে পারেন।

সার প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনা

 

যদি এক বিঘা জমির জন্য আপনি সার প্রয়োগ করতে চান; তাহলে এক্ষেত্রে খরচ খুবই কম। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার জৈব সার যথেষ্ট। এমনিভাবে আপনার যত বিঘা জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করবেন; সে হিসেবে সার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত, গোবর সার ও ইউরিয়া বেশি ব্যবহৃত হয়।

 

ড্রাগন ফলের গাছ জলাবদ্ধতা এবং খরা সহ্য করতে পারে না। মোটকথা, একে ভারসাম্যপূর্ণ ভাবে সেচ দিতে হবে। প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর একবার করে সেচ দিতে হবে।

 

এছাড়া যে গাছে ফল ধরেছে; সে গাছে ফুল ফোঁটার সময় একবার, মটরের সময় একবার এবং এর ১৫ দিন পর আরেকবার – মোট ৩ বার আপনাকে ফলদায়ক গাছে পানি সেচ দিতে হবে।

 

রোগ এবং পোকামাকঁড়ের আক্রমনে যা করবেন

 

অন্যান্য বৃক্ষের তুলনায় ড্রাগন ফলের বৃক্ষে রোগবালাই এবং পোকামাকঁড় এর আক্রমন সাধারণত অনেক কম হয়ে থাকে। তবে গাছের গোঁড়ায় পানি জমে জলাবদ্ধতা হলে রোগ হতে পারে। এজন্য পানি যেন না জমে থাকে, সে বিষয় আপনাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

 

এছাড়া ড্রাগন গাছের কান্ডে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। এর ফলে আক্রান্ত স্থান হলুদ হয়ে কালো রঙের হয়ে পঁচে যেতে পারে। একইভাবে গাছের গোঁড়া অনেকসময় পঁচে যেতে পারে। এজন্য রিডোমিল জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে পারেন।

ফল সংগ্রহের নিয়ম

 

ড্রাগন ফলের গাছে মে মাস থেকে ফুল আসে এবং জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফল কেটে সংগ্রহ করা যায়। ফুল ফোটার এক মাস পর ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়।

 

এই গাছের ফল পাকলেও নিজ থেকে পড়ে যায় না। প্রতিটি গাছ থেকে ৩ থেকে ১০ কেজি ফল সংগ্রহ করা যায়। গাছ যত বেশি পুরনো হয়, ফলও তত বেশি পাওয়া যায়।

 

ড্রাগন ফলের কাটিং থেকে চারা রোপনের পর এক থেকে দেড় বছর বয়সের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল যখন সম্পূর্ণ লাল রঙ ধারণ করে তখন সংগ্রহ করতে হয়। বছরে ৫-৬টি পর্যায়ে ফল সংগ্রহ করা যায়।

 

ড্রাগন ফল চাষাবাদের খরচ

 

প্রাথমিকভাবে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ ছাড়াই ড্রাগন ফল চাষ শুরু করা যায়। ড্রাগন ফল চাষ অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। অনেকে ভাবতে পারেন যে, প্রতি বিঘা জমিতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ লাগে। কিন্তু প্রতি বিঘাতে মাত্র ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচে এই ফলের চাষাবাদ শুরু করা যায়।

 

শুধুমাত্র চারা কিনে নিয়ে আপনি আপনার জমিতে চাষ কার্যক্রম শুরু করতে পারেন। চারার দাম বয়স অনুপাতে ১০ থেকে ৫০ টাকার মতো হয়ে থাকে। এক বিঘা জমির জন্য মাত্র ২০০০/- থেকে ২৫০০/- টাকার জৈব সার লাগে।

 

ড্রাগন ফলের উপকারিতা

 

এই ফলটি খেতে স্বাদে মজাদার এবং নানা স্বাস্থ্যকর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। ড্রাগন ফল এ প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৯-১০ গ্রাম শর্করা, ৮০-৮৫ গ্রাম পানি, ৩৫-৫০ কিলক্যালরি খাদ্যশক্তি, ০.৩৩-০.৯০ গ্রাম আঁশ, ১৫-৩৫ গ্রাম ফসফরাস, ০.১-০.৫ গ্রাম প্রোটিন, ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি সহ ইত্যাদি।

 

ড্রাগন ফলে ফাইবার বা আঁশ এর উপস্থিতি থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের জন্য উপকারি। এটা হজমের জন্য আর পেটের জন্য উপকারী একটি খাবার। এছাড়া এতে ক্যারোটিন রয়েছে, যা চোখের জন্য উপকারী।

 

এতে আরও রয়েছে ক্যালসিয়াম যা মজবুত দাঁত ও হাড় গঠনে সহায়ক। ভিটামিন সি এর উপস্থিত থাকার কারণে চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী। এছাড়া শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রেও ড্রাগন ফল উপকারী। এই ফলটি কাঁচা এবং শরবত আকারে খাওয়া হয়ে থাকে।

 

বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং মিষ্টি সুস্বাদু দারুণ একটি ফল হলো ড্রাগন ফল। মোটামুটি স্বল্প ও সহজ চাষ পদ্ধতি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীলতা, মানুষের নিকট চাহিদা – ইত্যাদি বিবেচনায় এই ফলটির চাষ লাভজনক হিসেবে প্রতীয়মান।

 

অন্যান্য ফল চাষের ক্ষেত্রে যেমন ঘূর্ণিঝড়ে বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং পোকামাকঁড় এর আক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে; ড্রাগন ফল এর ক্ষেত্রে সেটা খুবই কম। তাই আপনি মাত্র এক বিঘা জমি থাকলে, সেখানে ড্রাগন ফলের চারা লাগিয়ে এর চাষাবাদ শুরু করতে পারেন।

 

Visited 6 times, 1 visit(s) today

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here