মাছ চাষ বর্তমানে খুব লাভজনক ব্যবসা। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও উপায়। আর বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সবচেয়ে আধুনিক উপায়।
আধুনিকতার ছোঁয়া এখন পুরো বিশ্বে। বিশ্বের প্রায় ছোট-বড় সব দেশেই রয়েছে আধুনিকতা। কোন দেশে এখন আর পিছিয়ে নেই।
আর এই সবকিছুর মধ্যে আরেকটি আধুনিক উপায় হল বায়োফ্লক। তো প্রথমে আমরা জেনে নেই যে, বায়োফ্লক কি ?
বায়োফ্লক এমন একটি পদ্ধতি যা জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে উৎপাদিত হয় ।
এসব ফ্লকে যেসব উপাদান থাকে তা মাছের পুষ্টির যোগান দেয়। বায়োফ্লক পদ্ধতি ব্যবহারে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা সম্ভব ।
তবে আমাদের দেশে কিছু উল্লেখযোগ্য মাছ বেশি চাষ করা হয়। যেমন তেলাপিয়া ,কই,শিং,রুই ,মাগুর, গুলশা ,পাবদা, ও চিংড়ি ইত্যাদি।
তবে বায়োফ্লক এ চিংড়ি চাষ টাই একটু বেশি করা হয়। বায়োফ্লক চাষের ক্ষেত্রে কোন বড় পুকুর, নালা বা ডোবার প্রয়োজন নেই ।
মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তিতে বাড়ির আঙিনা, ছাদ কিংবা পরিত্যক্ত জায়গা ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক পরামর্শ অনুসরণ করে অধিক মাছ চাষ করা যায়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। এটি যুবসমাজের জন্য অত্যন্ত সফল একটি ব্যবসা।
বেকারত্ব দূরীকরণে বায়োফ্লক পদ্ধতি একটি দারুণ ভূমিকা পালন করে ।
কেননা এতে করে স্বল্প খরচে ভাল আয় করা সম্ভব । এটি বেকারদের জন্য আয়ের উৎস ।
এছাড়া যারা স্বল্পশিক্ষিত আছে, তারা যদি ঠিকভাবে প্রশিক্ষণ নেয় তাহলে তারাও খুব ভালোভাবে এটা শুরু করতে পারে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের বিস্তারিত
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে আগে প্রশিক্ষণ নিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। বায়োফ্লক এর মাছ ট্যাংকে চাষ করা হয়।
জৈব বর্জ্যের মাধ্যমে মাছের পুষ্টির ব্যবস্থা করা হয় ।বায়োফ্লক এ খরচ খুব কম।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে বায়োফ্লক হলো উন্নত মানের ব্যাকটেরিয়া। আর এটির মাধ্যমে মাছের পুষ্টি নিশ্চিত হয়।
বায়োফ্লক এ ছোট ছোট ট্যাংকের পানি ভরাট করে মাছ চাষ করতে হয়।
আর এক্ষেত্রে আপনাকে ট্যাংকের পানি কম পরিবর্তন করতে হবে । অল্প জায়গায় অধিক মাছ চাষ করা যায়। এটিতে কোন প্রকার পরিবেশ দূষিত হয় না।
বায়োফ্লকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রোবায়োটিক ।এটি একটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার আগে, অবশ্যই অবশ্যই আপনার এই সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার আগে আপনাকে কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে যেমন:
১ বায়োফ্লক এর পানিকে আপনার জীবাণুমুক্ত করে তারপর ব্যবহার করতে হবে ।এক্ষেত্রে আপনি বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতে পারেন।
তবে অবশ্যই পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে নিতে হবে।
২. বায়োফ্লক চাষের ট্যাংক আপনাকে ব্লিচিং দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে সেটাকে শুকাতে হবে ভালো করে।
৩. বায়োফ্লক বা পুকুর হোক মাছ চাষের যথার্থ পিএইচ 6.5 থেকে 8.5 থাকতে হবে ।আর এ পি এইচ এর মান কম হলে চুন দিতে হবে আর বেশি হলে কিছু করতে হবেনা এরেটর চালিয়ে যেতে হবে।
৪. 1 লাখ লিটার পানিতে 500 গ্রাম চুন দিতে হবে।
৫. পানির রং যখন সবুজ দেখায় এবং ছোট ছোট কণা দেখা যায় তখন বুঝতে হবে আপনার ফ্লক তৈরি।
৬. যারা এই ব্যবসায় একেবারে নতুন তারা তেলাপিয়া মাগুর মাছ চাষ করে দেখতে পারেন।
৭.যদি আপনাদের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবারহ না থাকে, তাহলে আপনার এই ব্যবসা করার চিন্তা মাথায় আনার দরকার নেই।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষের উপকরণ
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে আপনার খুব বেশি খরচ পড়বে না তবে কিছু জিনিস লাগবে যেমনঃ
১. চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ
২. এরেটর পাম্প
৩. লোহার খাঁচা
৪. ত্রিপল
৫. অক্সিজেন সরবরাহের জন্য মটর
৬. টিডিএস মিটার
৭. অ্যামোনিয়া টেস্ট কিড
৮. বিদ্যুৎ
৯. পিএইচ মিটার
১০. মাছের পোনা, মাছের খাবার ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার নিয়ম
ভালো প্রশিক্ষণ বা এ সম্পর্কে টুকটাক ধারণা থাকলে এ ব্যবসা শুরু করা যায়। আর এর জন্য আপনাকে প্রথমে ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে।
বায়োফ্লক এ আপনি কত টাকা বিনিয়োগ করবেন ,তা নির্ভর করে ট্যাংকের আকার ও আয়তন এর উপর।
আপনাকে ট্যাংকের পানির গুণাগুণ সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আপনাকে ট্যাংকের পানি খুব কম পরিবর্তন করতে হবে। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার নিয়ম হলো:
১. প্রথমে একটি ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে। তারপর এটি ব্লিচিং করে ভালো করে জীবাণুমুক্ত করে, রোদে শুকাতে হবে।
২. পানির তাপমাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পানিকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পানিতে কোন প্রকার আয়রন থাকা যাবে না।
৩. ট্যাংকে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সাপ্লাই এর জন্য এরেটর পাম্প স্থাপন করতে হবে।
এরপর আপনাকে পানির ট্যাংকে পানি ভরাট করে তাতে ফ্লক তৈরি করতে হবে। ঠিকমতো অক্সিজেন সাপ্লাই করতে হবে।
পানির রং যখন সবুজ হয়ে উঠবে তখন বুঝতে হবে মাছ চাষের জন্য পানি তৈরি। তখন আপনি আপনার পছন্দমত পোনা ছাড়বেন । এভাবেই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়।
মাছ চাষে ফ্লক তৈরির কলাকৌশল।
বায়োফ্লক এ মাছ চাষ করার ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে ফ্লক তৈরি করতে হবে। আর ফ্লক তৈরিতে তিনটি ফ্যাক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলঃ
১. নাইট্রোজেন
২. কার্বন
৩. প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া
পানিতে ফ্লক তৈরিতে_ প্রথম ডোজ এ নিতে হবে 50 গ্রাম প্রোবায়োটিক, 500 গ্রাম চিটাগুড়, 10 টন পানির ক্যাপাসিটি ট্যাংক এর জন্য।
তারপর 10 টন ট্যাংকির জন্য 10 লিটার পানি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ,ভালোভাবে মিশিয়ে ৮-১০ ঘণ্টা করে কালচার প্রয়োগ করতে হবে।
দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতিদিন 50 গ্রাম চিটাগুড় পানিতে গুলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তারপর থেকে 50 গ্রাম চিটাগুড় ও 10 গ্রাম প্রোবায়োটিক প্রতি টনের জন্য 1 লিটার পানি দিয়ে উপরের সময় ও নিয়মে বালতিতে কালচার প্রয়োগ করতে পারেন।
ফ্লকটি তৈরি হয়ে গেলে পানির রং সবুজ বা বাদামি দেখায়। পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুজির দানার মত দেখা যায়। পানিতে পানি এমোনিয়া মুক্ত থাকে।
বায়োফ্লক এ কি কি মাছ চাষ করা যায়?
উন্নত বায়োফ্লক মাছ চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যবসা। পুকুর বা ডোবার চেয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে অধিক মাছ চাষ করা যায়।
এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়।
তবে আমাদের দেশে তেলাপিয়া রুই ,শিং ,কৈ মাগুর ,পাবদা, গুলশা ও চিংড়ির চাষ বেশি হয়ে থাকে।
বিশেষ করে চিংড়ি ও তেলাপিয়া ফ্লক খেয়ে থাকে, তাই এ ধরনের মাছ চাষ করাই শ্রেয়। এছাড়া এ জাতীয় মাছের খাবার খরচ অন্যান্য মাছের তুলনায় খুবই কম ।
এজাতীয় মাছগুলো যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তাই এই চাষ করার ক্ষেত্রে এ জাতীয় মাছ চাষ করাই উত্তম।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষে লাভ
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে খুব সহজেই লাভবান হওয়া সম্ভব। এ পদ্ধতিতে মাছের বর্জ্য থেকে মাছের খাবার তৈরি হয়।
তাই 25% খাদ্যে শতভাগ মাছ উৎপাদন সম্ভব। বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে খুব দ্রুত মাছ বৃদ্ধি পায়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সঠিক জ্ঞানের মাধ্যমে মাছ চাষ করলে আপনি মাসে লাখ টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
যেমন কেউ যদি 10 হাজার লিটার দুইটি ট্যাংকে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে।
তাহলে প্রায় 70 থেকে 80 হাজার টাকা লাভ করতে পারবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের খরচ
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের খরচ খুবই অল্প। এই পদ্ধতিতে ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই কম থাকায় এটি অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যাবসা।
এই পদ্ধতিতে মাছ নিজের বর্জ্য থেকে সৃষ্ট খাবার খেয়ে থাকে ,এতে করে আলাদা করে মাছের খাবারের অর্থ খরচ করতে হয় না।
যদি কেউ লাখ টাকা খরচ করে এ ব্যবসা শুরু করে তাহলে, সে 70 থেকে 80 হাজার টাকা লাভ করতে পারবে। এ পদ্ধতিতে খরচের তুলনায় লাভের অংশটাই বেশি।
সবশেষে আমরা এটাই বলতে পারি যে, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। এবং সেইসাথে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পাল্টানো সম্ভব।
যারা বেকার স্বল্পশিক্ষিত রয়েছেন তারা খুব সহজেই ব্যবসা করে নিজেদের জীবন সবল ও সচল করতে পারেন সহজেই।