যারা সঠিক তথ্যটি জানেনা তাদের অনেকের ধারণা – ভিসা এবং পাসপোর্ট মূলত একই কাজ করে কিংবা একই মূল্য বহন করে। তবে প্রকৃতপক্ষে ভিসা এবং পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক। দুটির ধরন প্রয়োজনীয়তা এবং কার্য সক্ষমতা পৃথক। এবারের আর্টিকেলটি তারা আমরা মূলত ভিসা ও পাসপোর্ট কি সে বিষয়ে জানার পাশাপাশি ভিসা পাসপোর্ট এর মধ্যে পার্থক্য সমূহ তুলে ধরবো।
ভিসা কি? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা
ভিসা হলো একটি অনুমতি পত্র যা এক দেশের নাগরিককে অন্য দেশে প্রবেশ অবস্থান এবং সেখানে কাজ করার অনুমতি দেয়। ভিসা ছাড়া কোনভাবেই একটি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে প্রবেশ করা যায় না এবং কেউ প্রবেশ করলে সেটাকে অবৈধ অধিবাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে বলা যায় ভিসা হল এমন একটি ডকুমেন্ট যা এটা প্রমাণ করে যে একজন ব্যক্তি বৈধভাবে নিজ নাগরিকত্ব দেশ থেকে অন্য দেশে অবস্থান করছে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হয়ে থাকেন এবং আপনি চান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ করতে এক্ষেত্রে আপনাকে মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে এবং হিসাব পেয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণের জন্য বৈধভাবে অনুমতি পেয়ে যাবেন।
ভিসা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে বিভিন্ন প্রয়োজন অনুসারে। ক্ষেত্রবিশেষে ভিসা কেন প্রয়োজন তা পরবর্তী ধাপে আলোচনা করা হয়েছে।
ভিসা কেনো প্রয়োজন?
মূলত ভিসা একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। একটি দেশে কে কে প্রবেশ করতে পারবে, কে কতদিন বাইরে থেকে এসে দেশে থাকতে পারবে, কে তাদের দেশে কাজ করতে পারবে এ সকল বিষয়ে লিখিত পারমিশনই ভিসার মূল প্রয়োজনীয়তা।
১) একটি দেশ ভিসার মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত অধিবাসন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
২) ভিসা একটি দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
৩) ভিসা নিজের মাধ্যমে দেশ তার অর্থনৈতিক অবকাঠামে অবদান এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে
৪) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভিসার অবদান অনস্বীকার্য।
ভিসা মূলত তিনভাবে প্রদান করা হয়। যথা:
পাসপোর্টে: সাধারণত পাসপোর্টের একটি পাতায় লিখে, সিল দিয়ে বা স্টিকার লাগিয়ে ভিসা দেওয়া হয়।
ইলেকট্রনিক ভিসা (e-Visa): অনেক দেশ ই-ভিসা প্রদান করে যা অনলাইনে আবেদন এবং অনুমোদন করা হয়।
অন-অ্যারাইভাল ভিসা: কিছু দেশে আপনি পৌঁছানোর পর ভিসা পাবেন। সেগুলোকে অন-অ্যারাইভাল ভিসা বলে।
ভিসার প্রকারভেদ
বিভিন্ন প্রয়োজনের অনুসারে ভিসার প্রকারভেদ অনেকগুলো। এ পর্যায়ে জনপ্রিয় এবং সচরাচর ব্যবহৃত কিছু ভিসার প্রকারভেদ সম্পর্কে জানানো হলো:
পর্যটন ভিসা:
- এই ভিসাটি ভ্রমণ, দর্শনীয় স্থান দেখা এবং বন্ধু বা পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
- সাধারণত স্বল্প সময়ের জন্য (30-90 দিন) বৈধ থাকে।
ব্যবসায়িক ভিসা:
- ব্যবসায়িক মিটিং, সম্মেলন, প্রশিক্ষণ, বা ব্যবসায়িক অংশীদারদের সাথে দেখা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- সাধারণত 3-6 মাসের জন্য বৈধ থাকে।
শিক্ষা ভিসা:
- পড়াশোনার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ভিসার মেয়াদ অধ্যয়নের সময়কালের উপর নির্ভর করে।
কাজের ভিসা:
- কোন দেশে চাকরির জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ভিসার মেয়াদ চাকরির চুক্তির সময়কালের উপর নির্ভর করে।
অন্যান্য ভিসা:
- চিকিৎসা ভিসা, গবেষণা ভিসা, সাংস্কৃতিক বিনিময় ভিসা,
- ভিসার ধরন ভ্রমণের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে।
পাসপোর্ট কি? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা
পাসপোর্ট হল এক ধরনের ভ্রমণ ডকুমেন্টস যা একটি দেশের সরকার দ্বারা প্রদান করা হয়। নিজ দেশ ব্যতীত অন্য যেকোনো দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণকৃত ব্যক্তির জাতীয়তা ও পরিচয় বহন করে পাসপোর্ট। একটি পাসপোর্টে সাধারণত যে সকল বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে সেগুলো হলো:
- বাহকের নাম
- জন্মের তারিখ ও স্থান
- ছবি
- স্বাক্ষর
- জাতীয়তা
- পাসপোর্ট নম্বর
- জারির তারিখ
- মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ
- অন্যান্য চিহ্নিতকরণের তথ্য
উদাহরণস্বরূপ, ধরে নেয়া যাক আপনি যদি বাংলাদেশী নাগরিক এবং জাপান ভ্রমণ করতে চান। এক্ষেত্রে আপনাকে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হবে। আপনার পাসপোর্টে আপনার নাম, জন্মের তারিখ, ছবি, স্বাক্ষর, জাতীয়তা, পাসপোর্ট নম্বর, জারির তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, এবং অন্যান্য চিহ্নিতকরণের তথ্য থাকবে।
পাসপোর্টের আবেদনের জন্য ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের (https://www.dip.gov.bd/) ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন।
পাসপোর্ট কেনো প্রয়োজন?
আপনি নিজ দেশ ব্যতীত অন্য যেকোন দেশে যেতে নিশ্চয়ই আপনার ভিসা প্রয়োজন হবে? আর ভিসা করতে আপনাকে অবশ্যই পাসপোর্ট করতে হবে। পাসপোর্ট ব্যতীত কোনভাবেই ভিসা করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে এই কারণেই বেশিরভাগ মানুষ পাসপোর্ট করে থাকে। তবে স্পেসিফিক যে কারণগুলোর জন্য পাসপোর্ট করা প্রয়োজন সেগুলো এ পর্যায়ে উপস্থাপন করছি:
আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য
পরিচয় প্রমাণ: পাসপোর্ট হলো আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় আপনার পরিচয় প্রমাণের প্রধান Documents।
ভিসার জন্য: বেশিরভাগ দেশে প্রবেশের জন্য ভিসা প্রয়োজন। ভিসার জন্য আবেদন করার সময় আপনাকে অবশ্যই একটি বৈধ পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।
ইমিগ্রেশন: পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে আপনার জাতীয়তা এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাতে সাহায্য করে।
বিদেশে নিরাপত্তার জন্য
জরুরী পরিস্থিতিতে: বিদেশে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে পড়লে, আপনার পাসপোর্ট আপনার পরিচয় এবং নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সাহায্য করবে।
নিজ দেশের দূতাবাস/কনস্যুলেটের সহায়তা পেতে: বিদেশে থাকাকালীন আপনার যদি কোন সমস্যা হয়, তাহলে আপনার দেশের দূতাবাস/কনস্যুলেট আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। আপনার পাসপোর্ট থাকলে আপনি তাদের কাছ থেকে সহায়তা পেতে সক্ষম হবেন।
অন্যান্য ক্ষেত্রে
বিদেশে হোটেল বুক করার সময়: বেশিরভাগ হোটেলে আপনাকে আপনার পরিচয় প্রমাণের জন্য পাসপোর্ট দেখাতে হবে।
বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময়: বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আপনাকে অবশ্যই একটি বৈধ পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে, দেশীয়ভাবেও পরিচয় প্রমাণের জন্য পাসপোর্ট ব্যবহার করা হয়।
পাসপোর্টের প্রকারভেদ
সাধারণ পাসপোর্ট: এটি সকল বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। এটি সবুজ রঙের হয়ে থাকে। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ৫ থেকে ১০ বছর হয়।
ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট: এটি বাংলাদেশের কূটনীতিকদের জন্য প্রযোজ্য। এটি লাল রঙের হয়। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, কূটনীতিক এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। এই পাসপোর্টের দারুন দুটি সুযোগ আছে তা হলো:
- ভিসা ছাড়াই অনেক দেশে ভ্রমণের সুযোগ
- বিমানবন্দরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না
অফিসিয়াল পাসপোর্ট: এটি বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য। এটার রং হয় নীল। দেশে সকল সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য এই পাসপোর্ট দেয়া হয়। এটার মেয়াদও ৫ থেকে ১০ বছর অব্দি হয়ে থাকে।
এছাড়াও আরও কিছু বিশেষ ধরণের পাসপোর্ট আছে, যেমন:
- হজ পাসপোর্ট: যারা হজযাত্রা পালন করতে যান তাদের জন্য এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।
- জরুরী পাসপোর্ট: যারা জরুরি ভিত্তিতে বিদেশ ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।
- মেরিনার পাসপোর্ট: যারা সমুদ্রগামী জাহাজে কাজ করেন তাদের জন্য এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।
ভিসা এবং পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য
এবার আসা যাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। অনেকের ধারণা ভিসা এবং পাসপোর্ট প্রায় একই এবং এদের কাজও এক। মূলত কথাটা সত্য নয়। কেননা, ভিসা এবং পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক যা নিম্মে ছক আকারে উপস্থাপন করা হলো।
বৈশিষ্ট্য | ভিসা | পাসপোর্ট |
সংজ্ঞা | ভিসা হলো একটি অনুমতিপত্র যা একটি দেশের কর্তৃপক্ষ অন্য দেশের নাগরিকদের তাদের দেশে প্রবেশ, থাকা এবং কাজ করার জন্য প্রদান করে। | পাসপোর্ট হলো একটি ভ্রমণ দলিল বা ডকুমেন্টস যা একজন ব্যক্তির পরিচয়, নাগরিকত্ব এবং ভ্রমণের ইতিহাস প্রমাণ করে। |
উদ্দেশ্য | ভিসা একটি নির্দিষ্ট দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। | পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য ব্যক্তির পরিচয় প্রমাণ করে। |
বৈধতা | ভিসার মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকে, যা কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। | পাসপোর্টের মেয়াদ সাধারণত ৫ বা ১০ বছর হয়। |
আবেদন প্রক্রিয়া | ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে দেশটির দূতাবাস বা কনস্যুলেটে। | পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের পাসপোর্ট অফিসে। |
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র | ভিসার জন্য আবেদনের সময় পাসপোর্ট, ছবি, ভ্রমণ বীমা, আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ ইত্যাদি জমা দিতে হয়। | পাসপোর্টের জন্য আবেদনের সময় জন্ম সনদ, ছবি, পরিচয়পত্র ইত্যাদি জমা দিতে হয়। |
ফি | ভিসার জন্য আবেদন করতে ফি দিতে হয়। | পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতেও ফি দিতে হয়। |
অন্যান্য | ভিসা ছাড়াই কিছু দেশে ভ্রমণ করা সম্ভব। | পাসপোর্ট ছাড়াই কোনো দেশে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। |
পরিশেষে কিছু কথা
এই ছিলো ভিসা এবং পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য, যেখানে ভিসা ও পাসপোর্ট কি সে বিষয়ে জানান দেয়ার পর সেগুলোর কাজ ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছি। আশা করি ভিসা ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় গুলো ক্লিয়ার হয়েছে এবং ভিসা এবং পাসপোর্টের মধ্যে পার্থক্য গুলো বুজতে পেরেছেন। বাংলা ভাষায় সহজ ও সাবলীল ভাবে ভিসা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের জন্য বাংলা আলো ওয়েবসাইটের Visa-ভিসা নামক ক্যাটাগরিটি অনুসরণ করুন। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র সমূহ: