কৃষি

মাশরুম চাষ করার পদ্ধতি | মাশরুম এর চাহিদা ও উপকারিতা সহ চাষের বিস্তারিত

বর্তমানে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো মাশরুম চাষ। চাহিদার মোতাবেক ঠিক ভাবে চাষ করতে পারলে খুব ভালো ব্যবসা করা সম্ভব। জানুন মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।

আমরা প্রায় সবাই কমবেশি মাশরুম (Mushroom) এর কথা শুনেছি আর তা দেখেছি। যাকে অনেকেই “ব্যাঙের ছাতা” বলে থাকে।

ব্যাঙের ছাতা হিসেবে অনেকে চিনলেও, ব্যাঙ কিংবা ছাতা কারও সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই মাশরুমের। এটি উচ্চ আমিষ ও আঁশযুক্ত একটি সবজি, যা মানবদেহের জন্য অনেক উপকারি।

মাশরুম কে “গরীবের মাংস” বলে অনেকে। এটি খেতে সুস্বাদু। এটি ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন একটি ফসল, যা বর্তমানে অনেকেই চাষ করে যাচ্ছেন।

বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ এবং স্বাদ ভালো হওয়ায় এটি মানুষের নিকট সমাদৃত হয়েছে। এটি অনেকে বাসা বাড়িতেও চাষ করে থাকেন!

আমাদের আজকে জানার বিষয় হলো – মাশরুম চাষ পদ্ধতি নিয়ে। তো চলুন, সেগুলো জেনে নেয়া যাকঃ

মাশরুম এর পুষ্টিগুণ ও খাদ্য উপকারিতা

  • এতে রয়েছে অনেক পুষ্টি উপাদান এবং খাদ্য উপকারিতা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-
  • এটি একটি ওষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ
  • মাশরুমে রয়েছে পরিপূর্ণ প্রোটিন।
  • মানবদেহের জন্য ৯টি অ্যাসিডের প্রয়োজন অত্যাবশকীয়। মাশরুমে ৯টি অ্যাসিডই বিদ্যমান।
  • মাশরুমে রয়েছে এনজাইম ও ফাইবার; যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল দূর করতে সাহায্য করে।
  • যাদের ওজন বেশি, তাদের জন্য সাদা মাশরুম উপকারি। লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাশরুম খেলে শরীরের ওজন কমে।
  • মাশরুমে সেলেনিয়াম ও পলিফেনল নামের এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা উপকারি।
  • কফ ও ঠান্ডা রোধে মাশরুম উপকারি।
  • মানুসের দেহে ভিটামিন ও মিনারেল প্রয়োজন, যেটার অভা্ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে।

এছাড়াও আরও অনেক পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা রয়েছে মাশরুমে। এটি আমাদের জন্য একটি দারুণ উপকারি খাদ্য, যা আমরা সঠিক পরিমানে গ্রহন করতে পারি।

কেন মাশরুম চাষ করবেন?

মাশরুমের অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিগুণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ওষুধি গুণ। বর্তমানে অনেক মানুষই অনেক ধরনের খাবার খেতে পারেন না।

যেমনঃ স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে অনেকে গরুর মাংস খেতে পারেন না। তাদের জন্য বিকল্প খাবার হিসেবে মাশরুম ব্যবহার করা যায়।

এছাড়াও মাশরুম অনুর্বর জমি এমনকি ঘরেও চাষ করা যায়। বাড়ির আশেপাশের অব্যবহৃত জায়গায় অথবা উত্তর দিকের বারান্দা মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

মাশরুমের বীজ উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কাঁচামাল লাগে। যেমনঃ গমের ভুসি, খড়, কাঠের গুঁড়ো ইত্যাদি – যা সহজলভ্য। বাংলাদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

যারা পরিবারের মধ্যে বেকার আছে, তারা তাদের পারিবারিক শ্রমকে কাজে লাগিযে সহজেই মাশরুম চাষ করতে পারে। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মাশরুম চাষ করা সহজ।

তাই স্বাস্থসম্মত এ ফসলটি আপনি চাষ করার মাধ্যমে অর্থ আয় করতে পারেন এবং নিজেও মাশরুম ব্যবহার করে উপকার পেতে পারেন।

কেমন মূলধন লাগে মাশরুম চাষ করতে?

ঘরোয়া এবং পারিবারিকভাবে মাশরুম চাষ করার জন্য খুব বেশি মূলধন লাগে না। মাত্র ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা হলেই এ ব্যবসা শুরু করা যায়।

কেউ যদি বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ শুরু করতে চায়, তাহলে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা মূলধন বিনিয়োগ করে মাশরুম চাষ শুরু করতে পারে।

বর্তমানে মাশরুম চাষের সহায়ক একটি যন্ত্র পাওয়া যায়। যেটির নাম হলো – স্টেরিলাইজেশন কাম ইনোকুলেশন চেম্বার। এটি ব্যবহার করে মাশরুম সহজ উৎপাদন কাজ চালানো যায়।

এটির দামও তেমন বেশি নয়। যন্ত্রটি ব্যহারের সুবিধা হলো একইসাথে বীজ এবং সাবস্ট্রেট জীবাণুমুক্তকরণ

এবং বীজ প্রতিস্থাপন/ ইনোকুলেশন করা যায় অর্থাৎ আটোক্লেভ ও ক্লিনবেঞ্চের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে সাধারণত বিস্তারিত আকারে এসব যন্ত্রের ব্যাপারে শেখানো হয়ে থাকে।

মাশরুম চাষ পদ্ধতি

সাধারণত দুই উদ্দেশ্যে মাশরুম চাষ করা হয়। একটা  হল ঘরোয়া উদ্দেশ্যে আর দ্বিতীয় হলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে।

ঘরোয়াভাবে মাশরুম কিভাবে চাষ করবেন, সে ব্যাপারে বলছি..

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ এর অনুকূল আবহাওয়া রয়েছে। এছাড়া শীতকাল হলো ওয়েস্টার মাশরুম চাষের জন্য উপযুক্ত সময়।

এছাড়াও আমাদের দেশে ভূমি ওয়েস্টার মাশরুম চাষের জন্য অনুকূলে রয়েছে। প্রধানত ৩টি উপকরণ দরকার এই ধরনের মাশরুম চাষ করার জন্য। এগুলো হচ্ছে – মাশরুমের বীজ, খড় এবং পলিথিনের ব্যাগ।

চাষ রিলেটেড দ্রব্য পাওয়া যায় – এমন অনলাইন শপিং সাইট থেকে, কৃষিদ্রব্য পাওয়া যায় এমন দোকান থেকে অথবা মাশরুম বিষয়ক ট্রেনিং সেন্টার মাশরুমের বীজ কিনে নিতে হবে।

চাষের জন্য প্রথমে আধা ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি মাপের খড় কেটে নিতে হবে। তারপর জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত গরম পানিতে প্রায় ২০ মিনিট ফুটাতে হবে। অথবা ব্লিচিং পাউডার ও চুন মেশানো পরিষ্কার পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন।

ফুটানো বা ভেজানোর পরে পানি এমনভাবে ঝরাতে হবে, যাতে হাত দিয়ে খড় চাপলে পানি না পড়ে কিন্তু হাতে একটা ভেজা ভাব থাকতে হবে।

প্রক্রিয়া

পরবর্তীতে একটি পলিব্যাগের মধ্যে দু’ইঞ্চি মোটা পুরু করে খড় বিছিয়ে তার ওপর ব্যাগের ধার ঘেঁষে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে।

বীজের উপরে আবার খড় ও খড়ের উপর আবার বীজ, এইভাবে প্রায় ৬/৭টা স্তর তৈরি করে পলিব্যাগের মুখ কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে শক্তভাবে বন্ধ করে দিন।

খড় বিছানোর সময় প্রতিবারই হাত দিয়ে ভালো করে চেপে দিন, যাতে খড়ের ভিতর বাতাস না জমে। এই বিষয়টা ভালমতো খেয়াল করে দেখে নিবেন।

এরপর, প্যাকেটে দশ-এগারোটার মতো ছোট ছোট ছিদ্র করে তুলা দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিন। যেন স্বাভাবিক হাওয়া চলাচল বজায় থাকে।

আবার তুলা থাকায় ধুলাও ঢুকারও তেমন সম্ভাবনা থাকে না। প্যাকেটটি ৮ বা ৯ দিনের জন্য কোনও অন্ধকার জায়গায় রাখুন।

অন্ধকার থাকলেও সমস্যা নেই তবে খেয়াল রাখবেন যে, উক্ত জায়গায় যেন বাতাস চলাচল করে। গুমড় অবস্থা যেন না থাকে।

জায়গাটি যাতে পরিষ্কার ও পোকা-মাকড়মুক্ত থাকে, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। মাশরুম চাষে মাছি অনেক ক্ষতি করে।

তারপর কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। সেই প্যাকেটে বীজের জায়গায় সাদা আস্তরণ দেখা দেয় কি না দেখতে হবে। এই সাদা আস্তরণ কে মাইসেলিয়াম বলা হয়।

অল্প কয়দিনের মধ্যে পুরো ব্যাগটাই মাইসেলিয়ামে ভরে গেলে তুলা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং আরও কয়েকটি ছিদ্র করে ব্যাগটিকে কিছুটা আলোর মধ্যে রাখতে হবে।

সরাসরি রোদে রাখা যাবে না। তবে ঘরের ভিতর যেটুকু আলো আসে, ততটুকুই যথেষ্ট। তবে অতি রোদ যেন না হয়। বাতাসে আর্দ্রতা বুঝে প্রয়োজন মাফিক প্যাকেটের উপরে মাঝে মাঝে পানি স্প্রে করবেন।

তারপর কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। ছিদ্র দিয়ে যদি পিনহেড দেখা যায়, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে, মাশরুম উৎপাদন হচ্ছে।

সময়কাল

সাধারণত, এর ২৭/২৮ দিনের মধ্যে মাশরুম খাওয়ার মতো উপযুক্ত হয়। এভাবে মাশরুম ঘরোয়া পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। প্রতি ব্যাগ থেকে ৩ বার ফলন মিলে থাকে।

পৃথিবীতে কয়েক হাজার প্রজাতির মাশরুম রয়েছে। কিন্তু সব প্রজাতির মাশরুম খাওয়া যায় না। মাত্র ১০০ প্রজাতির মতো মাশরুম আমাদের খাওয়ার জন্য উপযোগী।

বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে রঙচঙে এবং সুন্দর প্রজাতির কিছু মাশরুম দেখা যায়। এগুলো খাওয়া যায় না। এগুলোতে বিষ থাকে, য্র ফলে এটা কোনো মানুষ খেলে তার বেঁচে থাকার তেমন আর সম্ভাবনা থাকে না।

তাই খাবার উপযুক্ত মাশরুম খেতে হয়। যারা মাশরুম সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না, তাদের জন্য দরকার হলো ভাল মতো জেনে নেয়া। সেটা খাওয়ার ক্ষেত্রে হোক অথবা হোক চাষের ক্ষেত্রে।

এজন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো মাশরুম উন্নযন ইনস্টিটিউটে আবেদনপত্র দাখিল করে মাশরুম সম্পর্কে চাষের প্রশিক্ষণ নেয়া। আর যারা খাওয়ার কথা ভাবছেন, তারা এ ব্যাপারে ভারো মতো না জেনে আন্দাজে মাশরুম খাবেন না।

অনেকসময়, খাবারের উপযুক্ত মাশরুম খেলেও অনেকের মাথা ধরা, বমি হওয়া এমনকি জ্ঞান হারানোর মতো সমস্যা হয়। এজন্য যারা নতুন মাশরুম খেকে চান, তারা প্রথমে অল্প পরিমানে খেয়ে দেখতে পারেন।

এটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করা অনুচিত, কেননা এটি একটি স্বাস্থ্যকর ফসল। মাশরুম চাষ ব্যাপকভাবে হওয়া প্রয়োজন, যেন মানুষ উপকৃত হতে পারে।

ইতিকথা

মাশরুম একটি লাভজনক ফসল। এটিকে চাষ করার পর শুকিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করার মাধ্যমে আয় করা সম্ভব।

তাই যারা বেকার রয়েছেন, তারা অল্প বিনিয়োগে ঘরোয়াভাবে শুরু করতে পারেন মাশরুম চাষ।

এর মাধ্যমে দেশের বেকারত্বের হার কমানো সম্ভব। সেই সাথে পুষ্টিগুন ও উপকারিতায় ভরপুর এ খাদ্যের চাষের মাধ্যমে মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনাও বিদ্যমান।

 

Bangla Alo

Recent Posts

ইস্তিহাযা অবস্থায় রোজা || রমজানে নারীদের রোজার বিধান

ইস্তিহাযা অবস্থায় রোজা রাখার বিধান কি সে বিষয়ে জানতে প্রথমেই বুজতে হবে ইস্তিহাযা বিষয়টি কি।…

1 week ago

ইচ্ছাকৃত রোজা না রাখলে কি হবে? রোজা না রাখার শাস্তি ও বিধান

রহিম মিয়া, পেশায় রিক্সা চালক। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে তার সংসার…

1 week ago

রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে কি না? রমজানে ইনহেলার ব্যবহার

ইনহেলার যাকে সালবুটামল নামেও চিনে থাকে অনেকে, ব্যবহারের ফলে রোজা ভেঙ্গে যাবে কি-না সে বিষয়ে…

2 weeks ago

রোজার নিয়ত ও দোয়া || আরবী উচ্চরণ এবং বাংলা অর্থসহ ব্যাখ্যা

রোজা ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং এটি মুসলিমদের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় (1)…

2 weeks ago

রমজান মাসের প্রচলিত ভুল || রমজান মাসে যে ২০টি ভুল করা যাবে না

প্রচলিত কিছু ভুলের কারণে আমাদের রমাদান গুলো আমরা নষ্ট করে ফেলি। আমাদের আমল গুলো যথাযথভাবে…

3 weeks ago

বাংলাদেশের সেরা ১০ টি মেডিকেল কলেজ

বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সাথে সাথে, ভালো মানের মেডিকেল কলেজের তালিকা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।…

4 weeks ago