সূরা লাহাব বাংলা উচ্চারণ, অর্থ ও নাজিলের ইতিহাস (বিস্তারিত)

0
90
সূরা লাহাব

সূরা লাহাব বাংলা উচ্চারণ অর্থ ও নাজিলের ইতিহাস

কে ছিল এই আবু লাহাব? তার নামে কেন একটি সূরা নাজিল হয়েছিল? জানার ইচ্ছা নিশ্চয়ই সবার আছে? আসুন, জেনে নেই-

আবু লাহাব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আপন চাচা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পিতা এবং এই আবু লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আবু লাহাব ছিলেন কুরায়েশ নেতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের দশজন পুত্রের অন্যতম। তার আসল নাম আব্দুল ওযযা। অর্থ, ‘ওযযা দেবীর গোলাম’।

লালিমাযুক্ত গৌরবর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ায় তাকে ‘আবু লাহাব’ বা ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গওয়ালা’ বলা হ’ত। তার আসল নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তা ছিল তাওহীদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

তাছাড়া মূল নামের পরিবর্তে ডাক নামেই সে বেশী পরিচিত ছিল। এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাক নামই বেশী সম্পর্কিত।

নামাজের গুরুত্বপূর্ণ দোয়া | নামাজ পড়ার আগে ও পরে যেসব দোয়া পড়া উচিৎ

আবু লাহাব রাসূল (সাঃ)-এর নিকটতম শত্রু প্রতিবেশীও ছিলেন। উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন।

১. যারা উনার উপরে ঈমান এনেছিলেন ও উনার সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)। ২. যারা উনাকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু তালিব। ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব।

আবু লাহাব কখনোই তার ভাতিজার রাসূল (সাঃ)-এর সুনাম-সুখ্যাতি ও নবুয়ত লাভের মত উচ্চ মর্যাদা অর্জনের বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। যেমন মেনে নিতে পারেননি উনার অন্যতম বংশীয় চাচা আবু জাহেল ও তার সাথীরা। ফলে শুরু হয় শত্রুতা। তার পক্ষে সম্ভব কোনরূপ শত্রুতাই তিনি বাকী রাখেননি।

যখন রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হল,
“আর আপনি আপনার গোত্রের নিকট আত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করুন।”[সূরা আশ-শু’আরা ২৬: ২১৪]

তখন রাসূল (সাঃ) সাফা পর্বতে উঠে সকলকে ডাক দিয়ে একত্রিত করলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, “আমি যদি বলি যে একটি শত্রুদল ক্রমশই এগিয়ে আসছে এবং সকাল বিকাল যে কোনো সময় তোমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই করবো।’

তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, “আমি (শিরক ও কুফরের কারণে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি) এক ভীষণ আযাব সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছি।” একথা শুনে আবু লাহাব বলল, “ধ্বংস হও তুমি! এজন্যই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছো?” একথা বলে তিনি রাসূল (সাঃ)-কে পাথর মারতে উদ্যত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব অবতীর্ণ হয়।

আবু লাহাবের স্ত্রী ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন ‘আওরা বিনতে হারব উম্মে জামীল’। কুরায়েশদের নেতৃস্থানীয় মহিলাদের অন্যতম এই মহিলা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে সকল প্রকার চক্রান্তে ও দুষ্কর্মে তার স্বামীর পূর্ণ সহযোগী ছিলেন। সর্বদা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত, তোহমত ও চোগলখুরীতে লিপ্ত থাকতেন।

কবি হওয়ার সুবাদে ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে তার নোংরা প্রচারণা অন্যদের চাইতে বেশী ছিল। চোগলখুরীর মাধ্যমে সংসারে ভাঙ্গন ধরানো ও সমাজে অশান্তির আগুন জ্বালানো দু’মুখো ব্যক্তিকে আরবরা ‘ইন্ধন বহনকারী বা খড়িবাহক’ বলত। সে হিসাবে এই মহিলাকে কুরআনে উক্ত নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ার সুযোগে উক্ত মহিলা রাসূল (সাঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা উনার ‏বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা ছড়িয়ে বা পুঁতে রাখতেন। যাতে রাসূল (সাঃ) কষ্ট পান।

সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (সাঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে দেখতে পাননি।

আবু লাহাবের মৃত্যুও ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের দুঃসংবাদ মক্কায় পৌঁছবার সপ্তাহকাল পরে আবু লাহাবের গলায় গুটিবসন্ত দেখা দেয় এবং তাতেই সে মারা পড়ে। রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। কুরায়েশরা এই ব্যাধিকে মহামারী হিসাবে দারুণ ভয় পেত।

মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষেনি। ফলে তার লাশে পচন ধরে। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে। একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে।

অন্য এক বর্ণনা অনুসারে, তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয়। এবং তার সন্তানরাও তাকে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রেখে দিয়েছিল। ইসলাম বিদ্বেষী আল্লাহ ও রাসূলের শত্রু এইসব অহংকারী যালেমের পতন এভাবেই হয়। এই সূরার ভবিষ্যতবাণী সত্যে প্রমানিত হয়েছে। আর কুরআনের কথা এভাবেই সত্য প্রমাণিত হয়। আবু লাহাবের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার কোন কাজেই আসেনি। এভাবে এ সূরায় আবু লাহাব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা সত্য হতে দেখলো।

আসুন, এবার সূরা লাহাব সূরাটি পড়ে নেই-

(১) تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ
“তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাবিওঁ ওয়াতাব্বা”
‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।’

এখানে ‘তাব্‌বাত’ অর্থ ধ্বংস হোক। ‘ইয়াদা আবী লাহাব’ অর্থ আবু লাহাবের দুই হস্ত। অর্থাৎ আবু লাহাব স্বয়ং। আবু লাহাব রাসুল (সাঃ)কে আঘাত করার জন্য হাতে পাথর তুলে নিয়েছিলো। তাই এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে তার হস্তদ্বয়ের কথা। এখানে হস্তদ্বয় অর্থ ইহজগত ও পরজগত। অর্থাৎ তার ইহকাল-পরকাল দুই কালই ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত। অথবা এখানে হস্তদ্বয় কথাটির দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিত্ত ও প্রভুত্বকে।

(২) مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
“মা আগনা আনহু মালুহু ওয়ামা কাছাব”
‘তার ধন-সম্পদ আর সে যা অর্জন করেছে তা তার কোন কাজে আসল না’।

রাসূল (সাঃ) যখন উনার স্বজনদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন, তখন আবু লাহাব বললো, ভাতিজা! তুমি আমাকে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছো। কিন্তু আমি তো শাস্তির পরোয়াই করি না। প্রয়োজন হলে আমি আমার সন্তান-সন্ততি-ধন-সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে তোমার কথিত শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভ করবো। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোনো কাজে আসেনি। অর্থাৎ তার সঞ্চিত বিপুল বিত্ত-বৈভব ও উপার্জিত সম্পদ তাকে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

(৩) سَيَصْلَىٰ نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
“সাইয়াছলা না রান যা তালাহাবিওঁ”
‘অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে’।

“জাতা লাহাব” অর্থ লেলিহান অগ্নি। অর্থাৎ সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যখন আবু লাহাব দগ্ধীভূত হতে থাকবে দোজখের লেলিহান আগুনে।

(৪) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ
“ওয়ামরাআতুহু, হাম্মা লাতাল হাত্বোয়াব”
‘এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহনকারিণী’।

এখানে ‘ওয়াম্‌রাআতুহু’ অর্থ তার স্ত্রীও অর্থাৎ আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলকেও ভোগ করতে হবে একই পরিণতি। এবং ‘হাম্‌মালাতাল হাত্বব’ (অর্থ যে ইন্ধন বহন করে) আরবী ভাষায় পরনিন্দুককে বলা হয় কাষ্ঠ, বা ইন্ধন বহনকারিণী। অর্থাৎ পর নিন্দাকারিণী।

(৫) فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ
“ফী-জী-দিহা হাবলুম মিম মাসাদ”
‘তার গলদেশে খর্জুরপত্রের পাকানো রশি’।

অর্থাৎ খেজুরপাতা দিয়ে পাকানো রশি দিয়ে কাঁটাযু্ক্ত লতাগুল্ম বেঁধে ঘাড়ে করে বা গলায় ঝুলিয়ে সে বহন করে আনত। ‘মাসাদ’ হ’ল ইয়ামনে উৎপন্ন এক প্রকার গাছের পাকানো রশি। যা গাছের ছালপাতা দিয়ে বা চামড়া দিয়ে বা অন্যকিছু দিয়ে তৈরী হ’তে পারে। ঐ রশিই ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের রশি হবে। আবু লাহাবের স্ত্রীর মণিমুক্তাখচিত বহু মূল্যবান একটি কণ্ঠহার ছিল। যেটা দেখিয়ে সে লোকদের বলত, ‘লাত ও ওযযার কসম! এটা আমি অবশ্যই ব্যয় করব মুহাম্মাদের শত্রুতার পিছনে’। অথচ এ কণ্ঠহারই তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আযাবের কণ্ঠহার হবে।

এই সূরা থেকে আমাদের জন্য কি ম্যাসেজ আছে??

কালের বিবর্তনে হাজারো ইসলাম বিদ্বেষী ও আল্লাহ রাসূলের শত্রু আবু লাহাবের চরিত্রের লোক আসতেই থাকবে। আর এইরকম ধ্বংস তাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে।

এই সূরায় আল্লাহ আবু লাহাবের সমস্ত চেষ্টা সাধনা ও উপায় উপকরন (হাত, কর্ম, ধন-সম্পদ, আয়-উপার্জন)সহ তার ধ্বংসের কথা বলেছেন। এমনকি তার স্ত্রীর কথাও। যে ছিলো ইসলামের বিরোধিতায় তার সহযোগী। ইসলাম বিদ্বেষী এবং তাদের সহযোগীরা যে শুধু এই দুনিয়ায় পরাজিত হবে তা নয় বরং আখিরাতেও একে অপরের সহায়তা করতে করতে ভয়াবহ পরাজয়ের স্বাদ পাবে।

আল্লাহ ও তাঁর রাসুল(সাঃ) এর সাথে শত্রুতা ও বিদ্রোহের পরিনতি যে কী হতে পারে, এই সুরা তো তারই সাক্ষ্য বহন করছে। আল্লাহর রাসুলের(সাঃ) শত্রুর ভয়ঙ্কর পরিনতির ব্যাপারে এখানে একটি ভবিষ্যতবাণী রয়েছে। এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এ ভবিষ্যতবাণী সত্যে পরিনত হচ্ছে।

সেদিনের মত হাজারো আবু লাহাব ও উম্মে জামীলের ন্যায় ইসলামের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শত্রু চিরকাল থাকবে। এবং তারা অবশ্যই জাহান্নামী হবে। কিন্তু আল্লাহর নিকটে মযলূম মুমিনরাই প্রকৃত বিজয়ী এবং যালেমরা সর্বদাই পরাজিত।′

Cradit: Dr. Tuhin Malik

Visited 73 times, 3 visit(s) today

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here