২১ শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস হলো ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বহুভাষিকতাকে উন্নীত করার জন্য বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান বিশেষ।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক প্রথম ঘোষণা করা হয় এই দিবস। এই দিবস টিতে বাঙালীরা ভাষা শহীদ দের বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
এছাড়া ও ২০০২ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাব ৫৬/ ২৬২ গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন এর ধারণা শুরুই হয় বাংলাদেশ এর উদ্যোগে। বাংলাদেশী নাগরিক রা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন শুরু করে সকাল বেলা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার মাধ্যমে।
১৯৫৩ সাল থেকেই এই দিন টিকে বাংলাদেশে একটি সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো। আজকের আর্টিকেল এ আপনাদের জানাবো ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। তাহলে চলুন শুরু করা যাক…
২১ শে ফেব্রুয়ারী ও বাংলাদেশের ইতিহাস
২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস ‘আমর একুশে’ নামেও পরিচিত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর মূল এবং একটি স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ, এই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৫২ সাল এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী তে ভাষা শহীদদের রক্তদানের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তারা সম্পূর্ণ ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল না।
দেশটি প্রাথমিক ভাবে পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বিভক্ত হয়েছিল। ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন, দেশের দুটি দিক সম্পূর্ণ আলাদা, সামাজিক, সংস্কৃতি এবং ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই।
১৯৪৮ সালে, পশ্চিম পাকিস্তান উর্দুকে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করে ছিলো। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান এর দিকে বিক্ষোভ দেখা দেয়।
এলাকার জনসংখ্যার অধিকাংশই তাদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রাধান্য দেয়। অবশেষে ১৯৫২ সাল এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান এর জনগণ প্রতিবাদ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কর্মী ও ছাত্র দের প্রতিনিধিত্ব করে তারা পূর্ব বাংলার আইনসভায় চলে যান। গণআন্দোলন এর জবাবে পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে।
চার জন ছাত্রের গল্প
আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, সফিউর রহমান এবং আবদুস সালাম সেই গুলিতে মারা যান। আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েক জন বিক্ষোভকারী। ইতিহাসে এটি একটি খুব বিরল ঘটনা যখন লোকেরা একটি ভাষার জন্য লড়াই করার জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিয়ে মারা যায়।
ব্যাপক বিক্ষোভ এবং অন্যান্য অনেক আত্মত্যাগ পর থেকে সরকার অবশেষে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে সরকারী মর্যাদা প্রদান করা হয়। সেই থেকে পূর্ব পাকিস্তান এর জনগণ বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, অবশ্যই সরকার এর কাছ থেকে বৈধতা নিয়ে।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি প্রভাব থেকে নিজে দের মুক্ত করতে তারা জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়। বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গকারী যোদ্ধাদের সম্মান জানাতে বাংলাদেশ পরবর্তী তে শহীদ মিনার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।
বাংলা ভাষার ব্যবহার আনুষ্ঠানিক ভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে এক বাঙালি রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি পাঠান। রফিকুল কফি আনান কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের ভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে বলেন।
সে সময় রফিক ১৯৫২ সালের ঢাকা ট্র্যাজেডিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ প্রস্তাব করেন। চিঠিটি ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ -এ উত্তর দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় ইউনেস্কো ঘোষণা করেছিল যে প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে সারা বিশ্ব জুড়ে।
ভাষা আন্দোলনে শহিদদের অবদান
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল নয় টায় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা অমান্য করে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করে।
সশস্ত্র পুলিশ ক্যাম্পাস ঘেরাও করলে বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সোয়া এগারো টার দিকে শিক্ষার্থী রা বিশ্ববিদ্যালয় এর গেটে জড়ো হয়ে পুলিশ লাইন ভাঙার চেষ্টা করে।
পুলিশ শিক্ষার্থী দের সতর্ক করতে গেটের দিকে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থী দের একটি অংশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছুটে যায় এবং অন্যরা পুলিশ দ্বারা ঘেরাও করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর এর দিকে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশ কে গুলি চালানো বন্ধ করতে বলেন এবং শিক্ষার্থী দের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেন।
যাইহোক, পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন এর জন্য বেশ কয়েক জন ছাত্রকে আটক করে যখন তারা চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
গ্রেপ্তার এর কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্ররা পূর্ব বাংলার আইন সভার চারপাশে মিলিত হয় এবং বিধায়ক দের পথ অবরোধ করে, তাদের সমাবেশে তাদের জিদ উপস্থাপন করতে বলে।
ছাত্র দের একটি দল ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ গুলি চালায় এবং আব্দুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত এবং আব্দুল জব্বার সহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে।
দোকানপাট, অফিস এবং গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একটি সাধারণ ধর্মঘট শুরু হয়। এভাবে জীবন দিয়ে ভাষা শহীদরা বাংলাদেশ এর মাতৃভাষায় অবদান রেখেছেন। তাদেরই অবদান এর পরিপ্রেক্ষিতে এখন সারা বিশ্বে পালিত হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস।
কেনো দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস বলা হয়
১৯৫২ সাল এর ভাষা আন্দোলন এর শহীদ দের স্মরণে প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস সারা দেশে শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। দিনের প্রথম প্রহরে আমাদের ভাষা শহীদ দের সর্বোত্তম আত্মত্যাগ এর স্মরণে শোক এর গানের মাধ্যমে এই স্মরণসভা শুরু হয়ে থাকে।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক প্রথম ঘোষণা করা হয় এই দিবস। এই দিবস টিতে বাঙালী রা ভাষা শহীদ দের বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
এছাড়া ও ২০০২ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাব ৫৬/ ২৬২ গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ হয়।
কিভাবে মাতৃভাষা দিবসের সূচনা
ভাষা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে, শহীদ মিনার, একটি গৌরবময় এবং প্রতীকী ভাস্কর্য, গণহত্যার জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক স্থানীয় সরকার গঠনের পর, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস কে ছুটি ঘোষণা করা হয়। দিনটি বাংলাদেশে যেখানে এটি একটি সরকারি ছুটির দিন এবং কিছুটা কম পরিমাণে, পশ্চিমবঙ্গে শহীদ দিবস হিসেবে সম্মানিত হয়।
ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউনেস্কো সাধারণ সম্মেলন সিদ্ধান্ত নেয় যেটি ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে কার্যকর হয়, যখন এটি সর্বসম্মতি ক্রমে বাংলাদেশ এর দ্বারা জমা দেওয়া একটি খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ২৮ টি অন্যান্য দেশ সহ- স্পন্সর এবং সমর্থন করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্বীকৃতি ও দেশের সম্মান
ভাষা হল আমাদের বাস্তব ও অধরা ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশ এর সবচেয়ে বড় শক্তিশালী যন্ত্র। সারা বিশ্বে যখন বাংলাদেশের মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রকাশ করা হয় তখন দেশের সম্মান অনেক গুণেই বেড়ে যায়।
মাতৃভাষার প্রচার এর সকল পদক্ষেপ শুধুমাত্র ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিক শিক্ষা কে উৎসাহিত করবে না বরং সারা বিশ্বে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পূর্ণ সচেতনতা বিকাশ করবে। তার সাথে সাথে বোঝাপড়া, সহনশীলতা এবং সংলাপের ভিত্তিতে সংহতিকে অনুপ্রাণিত করবে।
ইতিকথা
তাই আমরা বলতে পারি, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা দিবস বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি অমর একুশের ইতিহাস, তাৎপর্য ও উদযাপনের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। একুশের বাংলা ভাষা আন্দোলন ছাড়া বাংলাদেশী জাতীয়তার কথা ভাবাই যায় না।