আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের মাস হলো রমজান মাস। পবিত্র এই মাসে রোজা রাখা সকলের জন্য ফরজ। ফরজ এই কাজ করতে হলে মানতে হয় কিছু নিয়ম, চলতে হয় দেখানো পথে ও বিরত থাকতে হয় কিছু নিষেধাজ্ঞা থেকে। কেননা এমনও হতে পারে সে বিষয় গুলো সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকার কারণে ভঙ্গ হলো রোজা নামক ফরজ কাজটি। তাই এবারের আর্টিকেলে জানাবো সেই সকল বিষয় সম্পর্কে যেগুলো ঘটার ফলে রোজা ভেঙ্গে যায় বা যেগুলো রোজা ভঙ্গের কারণ।
রোজা
সাধারণত আল্লাহ্র ইবাদতের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার কাজ হল রোজা। আরবীতে, রোজাকে “সাওম” (صوم) বলা হয় যার অর্থ “বিরত থাকা” বা “বর্জন করা”। বাংলায়, রোজা রাখা “উপবাস” নামে পরিচিত, যার অর্থ “আল্লাহ্র কাছাকাছি থাকা।”
রোজা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদের জন্য রমজান মাসে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক। রমজান যা ইসলামিক চন্দ্র ক্যালেন্ডারের নবম মাস। রোজা শুরু হয় ভোরবেলা এবং শেষ হয় সূর্যাস্তে। এই সময়ে মুসলমানদের খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা, সেইসাথে অশুদ্ধ চিন্তা ও কর্ম থেকে বিরত থাকে।
রমজান মাসে রোজা রাখার ধর্মীর দৃষ্টিকোণ এবং শারীরিক উভয় ধরনের উপকারিতা রয়েছে। এটি বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে এবং আল্লাহ্র সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় বলে বিশ্বাস করা হয়। রোজা অসহায়দের দুর্দশার অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে, সেইসাথে একজনের শরীর এবং আত্মাকে শুদ্ধ করার উপায় হিসাবে কাজ করে।
বেশ কিছু হাদিস (নবী মুহাম্মদের বাণী) রয়েছে যা রোজার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। এরকম একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “রোজা হল ঢাল সরুপ; এটি আপনাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সহীহ আল-বুখারী)
অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে একনিষ্ঠ বিশ্বাসের সাথে এবং আল্লাহর সওয়াব লাভের আশায়, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)
রোজা ভঙ্গের কারণ
জেনে নিলেন রোজা সংক্রান্ত ব্যাসিক কিছু তথ্য। এবার জেনে নেয়া যাক রোজা ভঙ্গের কারণ গুলো। মূলত রোজা রাখার ক্ষেত্রে যে সকল নিষেধাজ্ঞা গুলো রয়েছে সেগুলো করার ফলেই রোজা ভঙ্গ হয়। এই পর্যায়ে এক এক করে সেই কারণগুলো উপস্থাপন করা হবে যেগুলো করার মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ হয়।
রোজা ভঙ্গের সমস্ত কারণগুলোকে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা:
১) শরীর থেকে কোন কিছু নির্গত আমার সাথে সম্পৃক্ত কিছু ঘটলে। যেমন – সহবাস, ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি কর্ ও শিঙ্গা লাগানো, হস্তমৈথুন সহ আরো অনেক কিছু যা আর্টিকেলের বিস্তারিত ধাপে জানাবো হবে।
২) শরীরে কোন কিছু প্রবেশ করানো সংক্রান্ত ঘটনা ঘটলে। যেমন – কিছু পান করা, আহার গ্রহন, ধুমপান সহ আরো অনেক কিছু যা বিস্তারিত ধাপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
রোজা ভঙ্গের বিষয়ে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ছাড়া বা রোগ ছাড়া রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙে ফেলে, তার পুরো জীবনের রোজা দিয়েও এর ক্ষতিপূরণ হবে না। যদিও সে জীবনভর রোজা রাখে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩)
তাহলে বুজতে পারছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে রোজা ভঙ্গ করার ভয়াবহতা কতটা? তাই অবশ্যই আমাদের রোজা ভঙ্গের কারণ গুলো সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে এবং কোনো ভাবে যেনো রোজা ভঙ্গ না হয় সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
এই পর্যায়ে বিস্তারিত ভাবে রোজা ভঙ্গের কারণ গুলো একেক করে জানানো হবে ইনশাল্লাহ। নিম্মে উপস্থাপন করা হলো রোজা ভঙ্গের কারণ গুলো:
স্ত্রীর সাথে সহবাস করা
ইসলামে, রমজানের রোজার সময় স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন রোজা ভঙ্গ বলে মনে করা হয়। নিম্নোক্ত হাদিসের উপর ভিত্তি করে এই রায় দেওয়া হয়েছে:
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে, তখন সে যেন তার স্ত্রীর সাথে সহবাস ও ঝগড়া থেকে বিরত থাকে এবং কেউ তার সাথে ঝগড়া বা ঝগড়া করলে সে যেন বলে, ‘আমি রোজা রেখেছি.’ সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ’ রোজাদারের মুখ থেকে নির্গত অপ্রীতিকর গন্ধ আল্লাহর কাছে কস্তুরীর গন্ধের চেয়েও উত্তম।রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে, একটি তার ইফতারের সময় এবং অন্যটি যখন সে আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাত করবে। তখন সে তার রোজার কারণে খুশি হবে। (সহীহ আল-বুখারী)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) মুসলমানদেরকে রমজানের রোজার সময় যৌন মিলন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এর কারণ হল রোজা হলো আত্মশুদ্ধি এবং আত্মসংযমের সময়। অন্যদিকে যৌন মিলনকে একটি শারীরিক কাজ বলে মনে করা হয়, যা এই পবিত্রতার অবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়।
অতঃপর বলা যায়, রোজা থাকা অবস্থায় যৌন কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়াকে রোজার উদ্দেশ্যের প্রতি সম্মান বা বিবেচ্য বলে মনে করা হয় না। যেখানে রোজা একজনের তাকওয়া, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তি বৃদ্ধি করে। রোজার সময় শারীরিক আকাঙ্ক্ষা থেকে বিরত থাকার কাজটি আল্লাহর প্রতি একজনের আনুগত্য প্রদর্শন এবং আল্লাহ্র সাথে একজনের আধ্যাত্মিক সংযোগ বৃদ্ধি করার একটি উপায়।
হস্তমৈথুন করা
ইসলামে হস্তমৈথুনকে একটি পাপ কাজ (কবিরা গুনাহ) বলে মনে করা হয় এবং রমজানের রোজা রাখার সময় তো আরো বেশি করে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। হস্তমৈথুন করলে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং যে ব্যক্তি এতে লিপ্ত হয় তাকে অবশ্যই রোযার বাদ পড়া দিন কাটিয়ে দিতে হবে।
রোজা অবস্থায় হস্তমৈথুনের নিষেধাজ্ঞা নিম্নোক্ত হাদীসের উপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে:
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হস্তমৈথুন করে আল্লাহ তার ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দিকে মনোযোগ দেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে হস্তমৈথুন একটি পাপ কাজ বলে বিবেচিত এবং রোজার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রোজা হল আত্মশুদ্ধি এবং আত্মসংযমের একটি সময়, এবং হস্তমৈথুন সহ যেকোন ধরণের যৌন কার্যকলাপে জড়িত হওয়াকে একটি শারীরিক কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয় যা এই বিশুদ্ধতার অবস্থাকে ভঙ্গ করতে পারে।
উল্লেখ্য যে, এখানে এর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় যুক্ত রয়েছে। হস্তমৈথুন বলতে এখানে কোনো কিছুর দ্বারা (হাত কিংবা অন্য কিছু) বীর্যপাত করানো। তবে যদি হস্তমৈথুন করা শুরু করে এবং বীর্যপাত না করে তবে রোজা ভঙ্গ হবে না। এমতাবস্থায় তাৎক্ষনিক আল্লাহ্র কাছে তওবা করতে হবে।
আর যদি বীর্যপাত হয়ে যায় তবে তার রোজা ভঙ্গ হবে, উক্ত রোজা কাযা আদায় করে নিতে হবে এবং পাশাপাশি উক্ত দিনের বাকি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তাই রোজাদারের উচিৎ হবে যৌন উত্তেজনা প্রদান করে এমন কোনো কিছুর সংস্পর্শে না আসা।
পানাহার
মুখের দ্বারা কোনো কিছু (খাদ্য বা আহার) পাকস্থলীতে পৌছালে সেটিকে পানাহার হিসেবে গণ্য করা হবে। একই ভাবে যদি নাক দিয়ে করা হয় তবেও সেটিকে একই ধারায় বিবেচনা করা হবে। রোজার মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহ্র ইবাদত বন্দীগি হওয়া এবং সকল প্রকার পানাহার থেকে নিদিষ্ট সময় অব্দি বিরত থাকা।
অনেকের কাছে কিছুটা কনফিউশান লাগতে পারে নাকের মাধ্যমে কিভাবে পানাহার হয় সেই বিষয়টি। এক্ষেত্রে এক হাদিসে পাওয়া যায় যে, নবী (সাঃ) একদা বলেছেন: “তুমি ভাল করে নাকে পানি দাও; যদি না তুমি রোযাদার হও।” [সুনানে তিরমিযি (৭৮৮)] তাহলে এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যদি নাকের মাধ্যমে পানাহারের সমতুল্য বিষয় না হতো তবে নবী (সাঃ) উক্ত কাজে নিষেধ করতেন না।
শরীরে রক্ত দেয়া
কোনো ব্যক্তি যদি আহত হয় এবং কোনো কারণে তাকে রক্ত পুশ করতে হয়। আর সে ব্যক্তি যদি রোজাদার হয় তবে তার রোজা ভঙ্গ হবে। কেননা, আহার গ্রহনের অন্যতম কারন হলো শরীরে রক্ত প্রদান করা বা বৃদ্ধি করা।
তবে কোন কারণে যে ব্যক্তির রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, তার রোজা ভাঙ্গবে না; কারণ রক্ত ক্ষরণ তার ইচ্ছাকৃত ছিল না। [স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১০/২৬৪)] রোজা তখনই ভঙ্গ হবে যখন রক্ত দেয়া হবে।
তবে ট্রান্সফিউশন বা অন্য কোনো মাধ্যমে কাউকে শরীরে রক্ত দিলে ইসলামে রোজা ভঙ্গ হয় না। রক্তদানের কাজটিকে একটি নিঃস্বার্থ কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এটি ইসলামে উত্সাহিত করা হয়।
এমন কোন হাদিস নেই যা বিশেষভাবে রোজার সময় রক্ত দান করার বিষয়টিকে সম্বোধন করে। যার ফলে কিছু কিছু আলেমগনদের মতে এটি জাহেজ নয়। তবে অনুপায় হয়ে যদি রক্ত প্রদান করতেই হয় তবে তার রোজা ভঙ্গ হবে এবং উক্ত রোজা কাযা আদায় করে নিতে হবে। তথ্যসূত্র: শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ পৃষ্ঠা-৭১।
তবে এমন কিছু হাদিস রয়েছে যা দাতব্য কাজকে উৎসাহিত করে এবং অন্যদের সাহায্য করার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। যেমন, নিম্নোক্ত হাদীসে বলা হয়েছে:
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কষ্টে কাউকে সহজ করতে সাহায্য করে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সহজ করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অন্যকে সাহায্য করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং একটি পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত। রক্তদান অন্যদের সাহায্য করার একটি উপায় এবং তাই ইসলামে উৎসাহিত করা হয়।
অধিকন্তু, রক্তদানে এমন কোন পুষ্টিগত সুবিধা নেই যা রোজা ভেঙ্গে দেবে। উপবাসের উদ্দেশ্য হল একজনের তাকওয়া, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তি বৃদ্ধি করা এবং রক্তদান এই উদ্দেশ্যে হস্তক্ষেপ করে না।
শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করা
রোজা রাখার সময় “শিং লাগানো” মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করা জায়েজ নয়। কারণ এটিকে আত্ম-ক্ষতির একটি রূপ বলে মনে করা হয় এবং এটি দুর্বলতা এবং অসুস্থতার কারণ হতে পারে, যা রোজার উদ্দেশ্যকে দুর্বল করতে পারে।
নিম্নোক্ত হাদিসটি বিশেষভাবে “শিং লাগানো” এবং রোজা ভাঙার বিষয়টিকে সম্বোধন করে:
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানে শিঙ্গা লাগিয়ে রোজা ভঙ্গ করা ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করার মতো” (সুনানে আবু দাউদ)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, “শিং লাগানো” কাজটি রোযার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করার সমতুল্য বলে বিবেচিত হয় এবং তাই এটি অনুমোদিত নয়।
আরেকটি হাদিসে পাওয়া যায় – নবী (সাঃ) বলেন,: “যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোযা ভেঙ্গে যাবে।” [সুনানে আবু দাউদ (২৩৬৭), আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২০৪৭) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
এখানে “শিং লাগানো” বলতে বোঝায় ত্বকে ছোট ছোট ছেদ তৈরি করা এবং তারপর অল্প পরিমাণে রক্ত বের করার জন্য স্তন্যপান প্রয়োগ করা। এই অনুশীলনটি চিকিৎসাগতভাবে সুপারিশ করা হয় না এবং এটি সংক্রমণ, দাগ এবং অন্যান্য জটিলতার কারণ হতে পারে।
ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখ ভরে বমি করা
রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা ইসলামে রোজা ভঙ্গ করে। এর কারণ হল বমি করাকে একটি ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে করা হয় যা পেটের বিষয়বস্তু বের করে দেয়।
নিম্নোক্ত হাদিসটি বিশেষভাবে রোজার সময় বমির সমস্যাকে আলোকে ব্যাখ্যা করে:
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে তার রোজা কাযার প্রয়োজন নেই, তবে যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে তাকে অবশ্যই রোজা কাযা করতে হবে। (সুনানে আবি দাউদ)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা ভেঙ্গে যায় না, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা ভেঙ্গে যায় এবং রোযার বাদ পড়া দিনের কাযা আদায় করতে হয়।
ইবনে মুনযির বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করেছে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অভিমত (ইজমা) হচ্ছে তার রোযা ভেঙ্গে গেছে। [আল-মুগনী (৪/৩৬৮)] তবে যদি কারো পেট ফেঁপে থাকে তার জন্য বমি আটকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়; কারণ এতে করে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। [শাইখ উছাইমীনের মাজালিসু শাহরি রামাদান, পৃষ্ঠা-৭১]
ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা রাখার সময় বমি করা ইসলামে রোজা ভঙ্গ করে। হাদিসটি বিশেষভাবে এই সমস্যাটিকে সম্বোধন করে এবং রমজানে রোজার চেতনা বজায় রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। ইচ্ছাকৃত বমি করা এড়ানো এবং রোজার উপকারিতাগুলির উপর মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে রয়েছে আত্ম-শৃঙ্খলা, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রদর্শিত হয়।
মহিলাদের হায়েয ও নিফাসের রক্ত বের হওয়া
উক্ত বিষয়ে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন মহিলাদের হায়েয হয় তখন কি তারা নামায ও রোযা ত্যাগ করে না!?” [সহিহ বুখারী (৩০৪)]
তাই কোন নারীর হায়েয কিংবা নিফাসের রক্ত নির্গত হওয়া শুরু হলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে; এমনকি সেটা সূর্যাস্তের সামান্য কিছু সময় পূর্বে হলেও। আর কোন নারী যদি অনুভব করে যে, তার হায়েয শুরু হতে যাচ্ছে; কিন্তু সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত রক্ত বের হয়নি তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে এবং সেদিনের রোযা তাকে কাযা করতে হবে না।
অন্য এক হাদিসে এসেছে – নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “আমাদেরকে ঋতুস্রাব চলাকালীন বাদ পড়া রোযাগুলো কাযা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু নামায নয়।” (সহীহ বুখারী)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ঋতুস্রাব হলে মহিলাদের মাসিক শেষ হওয়ার পর ছুটে যাওয়া রোজাগুলো কাযা করতে হবে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) এর স্ত্রী আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, “আমার মাসিক চক্র দীর্ঘকাল ধরে চলত, এবং আমি কিছু রোজা মিস করতাম। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন আমার কাছে, ‘ছুটে যাওয়া রোজাগুলো কাযা করে নাও, কিন্তু ছুটে যাওয়া নামাজগুলো কাযা করো না।‘ (সহীহ বুখারি)
এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে তাদের মাসিক শেষ হওয়ার পর ছুটে যাওয়া রোজাব গুলো কাযা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আমাদের প্রসব পরবর্তী রক্তপাত হতো এবং আমরা গোসল না করা পর্যন্ত রোজা রাখতাম না বা নামাজ পড়তাম না।” (সহীহ বুখারী)
এখানেও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়, এমনতাবস্থায় নারীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এবং উক্ত সময়ে যদি কেউ রোজা রেখে থাকে তবে সেটি ভঙ্গ হবে। পরবর্তীতে এটির কাযা আদায় করে নিতে হবে।
অন্যান্য যে কারণেও রোজা ভঙ্গ হয়। সেগুলো হলো:
- ধুমপান করা রোজা ভঙ্গের কারণ গুলোর মধ্যে একটি।
- এমন বস্তু খাওয়া যা মূলত খাওয়া যায় না। যেমন – কাঠ, লোহা, ইট, পাথর, মাটি, কয়লা, বালু ইত্যাদি।
- তুলা, সুতা, কাগজ, কাদামাটি, খড়কুটো গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে।
- নিজের থু থু মুখ থেকে বের করে সেগুলো গিলে ফেললে।
- কান ও নাকের ড্রপ দিলে বা ছিদ্র থেকে কোনো ঔষধ প্রদান করলে।
- দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে। এক্ষেত্রে যদি থুতুর পরিমাণের হয় এবং কন্ঠনালিতে পৌছ যায় তবে রোজা ভঙ্গ হবে।
- যারা পান খান, তারা যদি মুখে পান নিয়ে ঘুমায় এবং এই অবস্থায় সুবহে সাদিক হয় তবে রোজা ভঙ্গ হবে।
- রাত মনে করে সুবহে সাদিকের পর সেহরি খাওয়া
- বৃষ্টি ফোটা খাদ্যনালির ভেতরে চলে গেলে রোজা ভঙ্গ হবে।
- সুর্যাস্ত হয়ে গেছে এই ভেবে সময়ের আগে ইফতার করলে রোজা ভঙ্গ হবে।
রোজা কাজা ও রোজা কাফফারা কি?
আশাকরি ইতিমধ্য রোজা কাজা করা ও রোজার কাফফারা শব্দ দুইটি পেয়েছেন। যার অর্থ বা মানে অনেকের অজানা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উক্ত বিষয় গুলো সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে।
রোজা কাজা হলো: ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা ভেঙ্গে ফেলার রোজার প্রতিবিধান হিসেবে শুধুমাত্র রোজা আদায় করা এক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু আদায় করতে হবে না। অন্যদিকে রোজার কাফ করা হলো প্রতিবিধান হিসেবে অতিরিক্ত কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া।
এক্ষেত্রে একটি হাদিসের রেফারেন্স দিলে বিষয়টি আপনার কাছে স্পর্ষ্ট হবে বলে মনে করছি। রোজার কাফফারার বিষয়ে আপু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, “আমরা একতা রাসূল (সাঃ) এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক লোক এসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন – ‘হে আল্লাহর রাসূল আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ তোমার কি হয়েছে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, স্বাধীন করার মতো কোনো ক্রীতদাস তুমি মুক্ত করতে পারবে কি? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি একাধারে দুই মাস সওম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। এরপর তিনি বললেন, ৬০ জন মিসকিন খাওয়াতে পারবে কি? সে বলল, না।
এ সময় নবী (সা.)-এর কাছে এক ‘আরাক (ঝুরি) পেশ করা হলো যাতে খেজুর ছিল। তখন তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে দান করে দাও। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার চেয়েও বেশি অভাবগ্রস্তকে সাদকা করব? আল্লাহর শপথ, মদিনার উভয় প্রান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবগ্রস্ত কেউ নেই। রাসুল (সা.) হেসে উঠলেন এবং তাঁর দাঁত দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেন, এগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৩৬)
এই পর্যায়ে বুঝা যায়, যদি কারো রোজা কাফফারা হয় তবে তিনি রাসুলের বলা প্রথম তিনটি কাজ সিরিয়াল মোতাবেক করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনটি কাজের যেকোনো একটি কাজ করলেই হবে।
রোজা ভঙ্গের কারণ নয় এমন কিছু কাজ
এমন কিছু কাজ বা ঘটনা রয়েছে যেগুলো খটারফলে আমাদের অনেকের মনে হতে পারে রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে কিন্তু মূলত উক্ত কাজগুলোর কারণে রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এমতাবস্থায় সে ঘটনা বা কাজগুলো সম্পর্কে জানা উচিত যার ফলে রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে মনে করে আমরা পানাহার করি অথবা রোজা অন্য নিয়ম থেকে সরে না আসি। যে সকল কাজগুলো করার ফলে রোজা ভঙ্গ হয় না সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
- অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর ধুলোবালি ধোয়া কুয়াশা অথবা মশা মাছি প্রবেশ করলে
- অনিচ্ছাকৃতভাবে কানের ভেতর পানি প্রবেশ করলে
- চোখে ঔষধ অথবা সুরমা ব্যবহার করলে
- অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে অথবা বমি এসে আবার নিজে নিজে ফিরে গেলে
- শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করা অথবা অন্য কোন কিছুর ঘ্রান নিলে
- নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না
- শরীরে তেল ব্যবহার করলে
- মিসওয়াক করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে যদি রক্ত বের হয় সেটি যেনো গলার ভেতর না পৌছায়
- ঘুমের মধ্যে সপ্নদোষ হলে
- স্ত্রীকে চুম্বন করলে বা জরিয়ে ধরলে যদি বীর্যপাত না হয় তবে রোজা ভঙ্গ হয় না।
- দাঁতের ফাকে খাবার আটকে থাকলে সেটি গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হয় না।
পরিশেষে কিছু কথা
আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বত্তম জ্ঞান ধারণকারী। এবারের আর্টিকেলের বিষয় বস্তু ছিলো রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ। যেসব কারণে ভেঙ্গে যেতে পারে আপনার রোজা – সে কারন গুলো সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। কেবল এটিই নয়, বরং এর পাশাপাশি কোন কোন কাজের ফলে রোজা ভঙ্গ হয় না সে বিষয়েও যথাযথ ভাবে একই স্থানে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে করে বিষয় গুলো ধরতে ও বুজতে সুবিধা হয়। আশা করি রোজা রাখার ক্ষেত্রে এবারের আর্টিকেলে উপস্থাপিত বিষয় গুলো আপনাকে বেশ উপকৃত করবে। এমই ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে জানতে বাংলা আলো ওয়েবসাইটের ইসলাম নামক ক্যাটাগরিটি অনুসরণ করুন। ধন্যবাদ।