ইসলাম তার সূচনা থেকেই মানুষকে জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করে আসছে। প্রতিটি মানুষকে ইসলামেগুরুত্বের সঙ্গে জ্ঞান অর্জন করার কথা বলা হয়েছে।আলোবিহীন অন্ধকারে যেমন কেউ পথ চলতে পারে না,তেমনি জ্ঞান ছাড়াও প্রকৃত মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করা যায় না। দুনিয়া ও পরকালের ভালো-মন্দ বুঝতেও জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। সৃষ্টির সেরাজীব আশরাফুল মাখলুকাত হলো মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণি ও আমাদের মাঝে পার্থক্য হলো, ‘জ্ঞান থাকা’ বা ‘না থাকা’।
একমাত্র জ্ঞানই মানুষ কে অন্যান্য প্রানী থেকে উত্তম মর্যাদা প্রদান করেছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা ও বিবেকবোধ দিয়েছেন। যার দ্বারা মানুষ ভালো মন্দ যাচাই করতে পারে।তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে অজানাকে জানার সামর্থ্য শুধু মাত্র মানুষের মধ্যেই লক্ষনীয় গুণ। জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে কোরআন এবং হাদিসে বিভিন্নভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলামে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। এমন কোন বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ নেই যেই গ্রন্থে কিতাবুল ইলম বা জ্ঞানার্জন বিষয়ক অধ্যায় অনুপস্থিত। প্রত্যেক বিশুদ্ধ হাদিসের বইয়ে জ্ঞান অর্জন বিষয়ক আলাদা অধ্যায় রয়েছে। রাসুল (সা.) একটি হাদিসে জ্ঞান অর্জন সম্পর্কে বর্ণনা করেন, “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ”- ইবনে মাজাহ। আর ফরজ বর্জন করা কবিরা গোনাহ।
বলা ভালো,জ্ঞান বলতে এখানে ইসলামী জ্ঞান বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ একজন মুসলমানের ওপর আল্লাহর কি কি হুকুম রয়েছে এবং তা রাসূল (সা.) এর দেখানো নিয়ম অনুযায়ী কিভাবে পালন করা যায় তা জানতে হবে।জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রশংসায় মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন,”আপনি বলুন, যারা জ্ঞানী এবং যারা জ্ঞানী নয় তারা কি সমান হতে পারে?”
— সুরা জুমার, আয়াত-৯
।
জ্ঞানী লোকেরা উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত হবেন।পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন'(সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১)।
জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে যদি কেউ কোনো আলেমের দরজায় যায়,তখন তার প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে ১ বছরের ইবাদতের সওয়াব লেখা হয় (সুবাহানআল্লাহ)। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) এরশাদ করেছেন, দ্বীনি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য যে পথ চলতে থাকে, তার জন্য আল্লাহতায়ালা বেহেশতের পথ সহজ করে দেন।
জ্ঞানীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) এর হাদিস, “আবেদের ওপর আলেমের মর্যাদা হলো সমস্ত তারার ওপর চাঁদের মর্যাদার মতো।” জ্ঞান অর্জন ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) বলেন, ‘জ্ঞান অর্থ-সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা জ্ঞান তোমাকে পাহারা দেয়, কিন্তু অর্থকে উল্টো পাহারা দিতে হয়। জ্ঞান হলো শাসক, আর অর্থ হলো শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে আরো বৃদ্ধি পায়। ’ -ইমাম গাজ্জালি, এহইয়াউল উলুম : ১/১৭-১৮
ইবনে মাজা’র একটি হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন,হে আবু যর! তুমি যদি সকালবেলা গিয়ে কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা কর,তবে তা তোমার জন্য ১০০ রাকাত নফল নামাজ পড়া থেকেও উত্তম। আর যদি সকালবেলা গিয়ে ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা কর, তাহলে তোমার জন্য তা এক হাজার রাকাত নফল নামাজ পড়া থেকেও উত্তম।
জ্ঞানার্জনের আরেকটি ফজিলত হলো জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহভীরুতা দেখা হয়।হারিছ আল মুহাসিবি (রহ.) বলেন,দ্বীনি জ্ঞান মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা মানুষের অন্তরে প্রশান্তি আনে এবং আল্লাহর পরিচয় তাকে দায়িত্বশীল বানায়। -শুআবুল ঈমান লিল-বাইহাকি, ইলম অধ্যায়
অতএব, যারা জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকে তারা উল্লেখিত উপকারিতাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে তারা আল্লাহর ভয় থেকেও দূরে থাকে।
কিভাবে জ্ঞান অর্জন করা যায়?
জ্ঞানহীন মানুষ মূল্যহীন। তাই মানুষের উচিত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান নামক মূল্যবান সম্পদ আহরণ করা ।জ্ঞান অর্জনের উপায় বা মাধ্যম হলো ৩টি। যথা –
১) পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন
২) বিবেকবুদ্ধি, আকল,চিন্তাচেতনা ও গবেষণার মাধ্যমে অর্জন
৩) আল্লাহপ্রত্তদ নাজিলকৃত ওহীর জ্ঞান
জ্ঞান গোপন রাখা পাপ
কেউ যদি কোন বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করে এবং তা মানুষের প্রয়োজনের সময় প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে তবে সে পাপ করলো।কেননা জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য অর্জিত জ্ঞান গোপন করা পাপ। আল্লাহ’তালা বলেন, ‘‘স্মরণ করো, যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, তোমরা তা মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করবে এবং তা গোপন করবে না। তারপরও তারা তা অগ্রাহ্য করে ও তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে; সুতরাং তারা যা ক্রয় করে তা কত নিকৃষ্ট!’’
–(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৭)
আল্লাহ জ্ঞানকে গোপন রাখতে নিষেধ করেছেন।
হাদিসে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন,” যদি কাউকে জ্ঞান সম্পর্কিত কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় এবং সে তা জানা সত্ত্বেও গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে আগুনের লাগাম পরাবেন।”
— সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৫৮)
সারকথা
জ্ঞান অর্জন করা একটি মহৎ কাজ। তাছাড়া পার্থিব জীবনকে সুন্দর,শান্তিপূর্ণ ও শরিয়তসম্মতভাবে পরিচালনার জন্য ফরজ পরিমাণ জ্ঞানার্জন করতে হবে ও শিখতে হবে এবং পরকালের জন্য সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব ও ফজিলত জেনে আবশ্যক পরিমাণ জ্ঞানার্জন করে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন।