ইসলামে সুদ কেন হারাম । সুদকে কেনো হারাম করা হয়েছে ইসলামে? 

0
8

এটা আমরা সকলেই জানি যে সুদ দেয়া বা নেয়া কোনোটাকেই ইসলাম সমর্থন করে না। প্রশ্ন হচ্ছে কেনো করে না? ইসলামে সুদ কেন হারাম সেই বিষয়ে জানাবো এই আর্টিকেলের মাধ্যমে। যেহেতু এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি টপিক তাই প্রতিটি বিষয় যথাযথ রেফারেন্স সহকারে সহজে উপস্থাপন করবো যাতে পুরো ব্যাপারটি ক্লিয়ার ভাবে বুঝা যায়। তবে প্রথমেই জেনে নেয়া যাক সুদ বিষয়ক কিছু তথ্য। 

সুদ কি? 

সম্পদ বা অর্থ ধার নেয়ার সময় যে পরিমাণের অর্থ ধার নেয়া হয় সেটাকে আসল বা মূল অর্থ বলে এবং সেই অর্থের সাথে অতিরিক্ত যে অর্থ প্রদান করা হয় সেটাকে সুদ বলা হয়। সুদ প্রদানের সময়কাল ও নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে কতটুকু অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হবে সেটিকে সুদের হার বলা হয়। 

সুদ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে যার আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে الرِّبٰوا । তাহলে সুদ এবং রিবা কি একই? না, ব্যাপারটা এমন না। রিবা আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়, সেই তুলনায় সুদ একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সুদ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Interest অনেক স্থানে এটাকে Usury হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। 

ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক, কোনো চুক্তি বা লেনদেনের ব্যাতিত মূলধনের উপর অতিরিক্ত কোনো কিছু গ্রহন করাকেই সুদ হিসেবে ধরা হয়। যার মানে এই যে, নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শর্ত আরোপকৃত মূল টাকার উপর অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের তাগিদ দেয়াকেই সুদ বলা হয়। এই পর্যায়ে জানবো সুদের প্রকারভেদ সম্পর্কে।  

সুদের প্রকারভেদ 

অনেকের ধারনা সুদ তো সুদই ঋনের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহন করা। এর মধ্যে কিসের প্রকারভেদ থাকতে পারে। জী অবশ্যই আছে, সুদ যে কেবল অর্থ বা মূল্যে পরিমাপ যোগ্য এবং প্রতিবার অর্থই হবে এমনটা নয়, আরো একটি বিষয় জরিত। তো মূলত সকল সুদকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে যেগুলো হলো: 

রিবা আন নাসিয়াহ: মূলত এটাকেই প্রধানত সুদ হিসেবে ধরা হয় এবং আমরা এটাকেই চিনে থাকি। এটা অর্থ দ্বারা লেনদেন হয় যেখানে মূল অর্থের সাথে মাসিক হারে প্রদান করতে হয় অতিরিক্ত কিছু অর্থ। এইখানে ঋণ পরিশোধের জন্য নিদিষ্ট একটি মেয়াদ থাকে এবং মূলধনের উপর অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের শর্ত যুক্ত করে দেয়া হয়। 

রিবা আল ফজল: এই টাইপের সুদ গুলো হাদিসের মাধ্যমে প্রমান পাওয়া যায়। এটি সাথে সরাসরি অর্থ যুক্ত নয় তবে পণ্য দ্বারা এই ধরনের সুদ লেনদেন করা হয়। যেকোনো ধরনের পণ্য কম পরিমাণের বিপরীতে বেশি বা অতিরিক্ত পরিমাণের লেনদেনের ফলে এই ধরনের সুদ উদ্ভব ঘটে। লেনদেনের অতিরিক্ত অংশটুকু এখানে সুদ হিসেবে গন্য করা হয় যাকে রিবা আল ফজল বলা হয়। 

সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি হতে বর্ণিত, একদা হজরত বিলাল (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে হাজির হলো। হজরত রাসূলুল্লা (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর পেলে? হজরত বিলাল (রা.) বললেন, আমাদের খেজুর নিকৃষ্টমানের ছিলো। আমি তা দু’সা এর বিনিময়ে এক ‘সা’ বারমি খেজুর বদলিয়ে নিয়েছি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ওহ! এতো নির্ভেজাল সুদ, এতো নির্ভেজাল সুদ, এতো নির্ভেজাল সুদ। কখনও এরূপ করো না। তোমরা যদি উত্তম খেজুর পেতে চাও নিজেরগুলো বাজারে বিক্রি করবে তারপর উন্নতমানের খেজুর কিনবে। আচ্ছা সুদ কি ও কত প্রকার সেটা জানা গেলো এবার দেখে নেয়া যাক সুদের ইতিহাস সম্পর্কে। 

সুদের ইতিহাস 

এই পর্যায়ে এসে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এটা কি নতুন যুগের প্রথা নাকি সেই প্রাচীন কাল থেকেই যুগে যুগে চলে আসছিলো এমন প্রথা? জী সেই প্রাচীন কাল থেকেই সুদের প্রচলন পৃথিবীতে রয়েছে, বলা হয়ে থাকে যার শুরু হয়েছিলো ইহুদীদের মাধ্যমেই। ইহুদীদের সঙ্গে সুদের গভির ভাবে সম্পর্ক লক্ষনীয়। মূলক ইহুদীরা যে সমাজে বাস করতো ঠিক একই সমাজ থেকেই সুদের প্রচলন শুরু। এ কাজে অত্যন্ত পাকা হওয়ার খাতিরে তারা সুদখোর হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করে। সুদের সাথে ইহুদীদের সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ বস্তুতঃপূত-পবিত্র বস্তু যা ইহুদীদের জন্য হালাল ছিল তাদের সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর পথে অনেককে বাধা প্রদান জন্য আমি তা হারাম করে দিয়েছি। এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্যও,যদিও তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং অন্যায় ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। বস্তুত তাদের মধ্যে যারা কাফের তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি “ 

ইহুদী ধর্মের লোকেরা খুব সুক্ষ ভাবে সুদের ব্যাপারটি সারা বিশ্বে প্রচার করেই চলেছে। অথচ ইতিহাসের শুরুতে তাদের বলতে শোনা গেছে,  তারা নিজেদের মধ্যে সুদের কারবার করে না অথচ অন্য ধর্মের লোকেদের সাথে সুদি কারবার করাতে তারা তাদের নিজেদের কাছে হালাল ভাবে উপস্থান করেছে। 

১২১৫ সালে প্রথমবারের মত ইহুদীদের সুদের কারবারের বিরুদ্ধে সম্মেলোন করা হয় যেখানে তুলে ধরা হয় তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ গড়ে তলে ইউরোপ। তারপর ১২৭২ সালে, ইংল্যান্ড সুদ বন্ধ করতে রুল জারি করে। ১২৭৫ সালে, কঠিন নিয়মের সাপেক্ষে সংসদে প্রস্তাবনা পাশ করে। ১৩৯১ সালে স্পেনের পক্ষ থেকে ইহুদীদের উপর গনহত্যার আদেশ দেয়া হয় সুদি কারবারের কারনে। সুদের ভয়াবহতা এতোটা গভিরে চলে গিয়েছিলো যে, ইহুদীদের শর্ততে এটা ছিলো যে, কেউ যদি যথাসময়ে সুদ প্রদান করতে ব্যর্থ হয় তবে তার শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেয়া হবে। 

ইহুদীদের সুদের প্রথা চালুর পিছনের উদ্দেশ্য ছিলো একদিন না একদিন সুদের মাধ্যমেই তারা পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করবে যা সম্পর্কে জানানো হয় বিখ্যাত বই The protocals of the elders of zion (1901) 

সুদ প্রদানে ইহুদীদের উদ্দেশ্য 

এই পর্যায়ে তারা ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ প্রদানের বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে বিশ্ব ঋণ প্রদান শুরু করে খুবই অল্প পরিমান সুদের হারের বিনিয়মে। তাদের এই কাজের পিছনের উদ্দেশ্য খুবই বৃহৎ। তাদের মতে, ঋণ একটি হাতিয়ার, যেকোনো সরকারকে দুর্বল করার জন্য। কারন যতদিন সেই ঋণ পরিশোধ না হবে ততদিন সেই দেশের সরকারকে তাদের প্রতি অনুগ্রহ থাকতে হবে। যার কারনে তারা খুবই অল্প পরিমাণের সুদের হারে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে যার পরিশোধের মেয়াদও অনেক বছর। 

সুদ দেয়া সম্পর্কিত হাদিস

সুদকে কেন্দ্র করে কোরআন হাদিসে বিভিন্ন সচেতনমূলক বার্তা রয়েছে। কোরআনে মোট ৪ টি সূরায় রিবা সংক্রান্ত ব্যাপার উল্লেখ করেছেন। যেগুলো হলো – “ সূরা রূমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ১ বার, সূরা নিসার ১৬০ আয়াতে ১ বার, সূরা আলে ইমরানের ১৩০ আয়াতে ১ বার এবং সূরা বাকারাহর ২৭৫ আয়াতে ৩ বার, ২৭৬ আয়াতে ১ বার ও ২৭৮ আয়াতে ১ বার (হে ইমানদার লোক, তোমরা সুদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের কাছে আগের সুদি কারবারে যে সব বকেয়া আছে তোমরা তা ছেড়ে দাও, যদি সত্যিই তোমরা ইমানদার হও) । “ তাছাড়া হাদিসের মধ্যে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে এই বিষয়ে যার কিছু নিম্মে উপস্থাপন করা হলো: 

  • তোমরাদের মধ্যে যারা সুদ গ্রহন করে, সুদ প্রদান করে, সুদ সংক্রান্ত হিসেব লিখে বা হিসাব রাখে, সুদ সংক্রান্ত সাক্ষ্য দেয় তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার লানত। আরো উল্লেখ যে এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সকলেই সমান। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)
  • রিবার গুনাহ সত্তর প্রকার, এবং এর মধ্যে সবচেয়ে কম শাস্তিকর এবং ভয়ংকর হলো একজন লোক তার আপন মায়ের সাথে ব্যাভিচারের ফলে যা শাস্তি হবে সেটার সমান (ইবনে মাজাহ, আল বাইহাকি) 
  • সেই সকল ব্যাক্তি মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে না এবং যদি দাড়ায়ও তবে সেটা হবে তার মত যাকে শয়তানের পরশ দিয়ে লালসায় মোহাচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। এটার কারন হলো, তারা বলে থাকে যে সুদ হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যের মতই। যেখানে আল্লাহ স্বয়ং ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম। 
  • রাসুল (সাঃ) বলেন, সুদ যদিও অর্থ বৃদ্ধি করে, কিন্তু এর শেষ পরিনীতি হয় স্বল্পতা (মুসনাদে আহমেদ) 
  • নবী সাঃ বলে, আল্লাহ ৪ ধরনের ব্যক্তিকে কখনই জান্নাতে প্রবেশ করতে দিবেন না, তারা হলো – যারা অভ্যাসগত ভাবে মাতাল, সুদ গ্রহনকারী, অন্যায় ভাবে এতিমদের সম্পদ আত্নসাৎকারী, বাবা মা এর প্রতি অবাধ্যতাকারী। 

সুতরাং সুদকে অবশ্যই না বলতে হবে। সুদ গ্রহন ও প্রদান উভয়ই গুনাহ এর কাজ। মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিৎ সকল প্রকার সুদ জরিত কাজকে না বলে হালাল ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা। জানুন হালাল ব্যবসা সম্পর্কে।  

সুদ ও মুনাফার পার্থক্য 

এতো সময় ধরে সুদ সংক্রান্ত বিষয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যার মধ্যে সুদ কি তার প্রকারভেদ ও ইতিহাস এবং কোরআন হাদিসের অনুযায়ী ইসলামে সুদ কেন হারাম সেই ব্যাপার গুলো। এই পর্যায়ে এসে একটি ব্যাপার সহজেই গুলিয়ে ফেলা যেতে পারে, যা হচ্ছে সুদ ও মুনাফা কি একই নাকি এদের মধ্যে মেজর কোনো পার্থক্য রয়েছে যাতে করে বোঝা যাবে কোনটা সুদ ও কোনটা মুনাফা। চলুন তবে একটি পার্থক্য ছকের মাধ্যমে এই ব্যাপারটি বুজিয়ে দেয়া যাক। 

সুদমুনাফা
সুদকে হারাম করা হয়েছেমুনাফাকে হালাল করা হয়েছে
ঋন প্রদানের মাধ্যমে নিদিষ্ট সময় পরে যে নিদিষ্ট হারা অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া হয় সেটা সুদব্যবসায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে সেখান থেকে মুনাফা অর্জিত হয়
সুদ নিশ্চিত এবং নির্ধারিত করা থাকে যা কোনো ভাবে কম করার সুযোগ থাকে নামুনাফা সর্বদা অনিশ্চিত, হতে পারে অর্থ বেড়েছে আবার হতে পারে অর্থ লোকসানে গেছে বিনিয়োগের ফলে
সুদ কখনই কোনো ব্যবসায়ের ঝুকি গ্রহন করে না মুনাফা অর্জন করতে চাইলে সর্বদা ঝুঁকি গ্রহন করতেই হবে
সুদ সর্বদা সময় ও ঋনের সাথ যুক্তক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা আসে
একটি মূলধনে সুদ একাধিক বার ধার্য করা যেতেই পারেবিনিয়োগের উপর একবারই কেবল মুনাফা অর্জন করা যায়
উৎপাদনশীলতা দিন দিন কমে উৎপাদনশীলতা দিন দিন বৃদ্ধি পায়
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় সুদের মাধ্যমেমুনাফার সাথে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই
মুদ্রাস্ফীতি বাড়েমুদ্রাস্ফীতি কমে
সুদের মাধ্যমে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়মুনাফার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়

পরিশেষে, এই ছিলো ইসলামে সুদ কেন হারাম সেই সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য যেখানে সুদ কি, সুদের প্রকারভেদ, এটি ইতিহাস সহ কোরআন এবং হাদিসে সুদ সংক্রান্ত যে বিষয় গুলো রয়েছে সেগুলো উল্লেখ্য করার মাধ্যমে পর্যাপ্ত দলিলের মাধ্যমে ব্যাপার গুলো বোঝানো হয়েছে। এমনকি সুদের সাথে মুনাফার যে পার্থক্য রয়েছে সেটাও ছক আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। যা পুরো ব্যাপার গুলো বুজতে সাহায্য করবে। আসুন সুদকে না বলি, সুদ সংক্রান্ত লেনদেন থেকে বিরত থাকি। 

Visited 16 times, 1 visit(s) today

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here