একান্তে নিরবে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার যোগাযোগ, আবদার, দীনতা, হীনতা ও বিনয় প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে দোয়া। দোয়ার মাধ্যমে বান্দা মহান প্রভূর কাছে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে। যে স্থানগুলোতে দোয়া করা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে দলিল-প্রমাণ এসেছে ও দোয়া করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে তার মধ্যে শেষ বৈঠকের দোয়া অন্যতম। অর্থাৎ নামাজে সালাম ফিরানোর আগে দোয়া।
দোয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
দোয়া হলো প্রাচুর্যের চাবিকাঠি। বান্দা দোয়ার মাধ্যমে অন্তর থেকে অহংবোধ দূর করতে পারে,আল্লাহর প্রতি বিনয় প্রকাশ করে এবং সর্বোপরি তাঁর অসীম রহমত লাভে ধন্য হতে পারে। দোয়া আনুগত্য ও দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ। বান্দা যখন দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার অভাব ও প্রয়োজনের কথা নম্রভাবে তুলে ধরে এইটা তিনি খুব বেশি পছন্দ করেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে একটি হাদিস পাওয়া যায় : ‘দোয়ার চেয়ে আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে উত্তম কোনো বস্তু নেই’(ইবনে মাযাহ, হাসান)। তবে আল্লাহ তায়ালার কাছে কোনো কিছু চাইতে,কোন আবদার কিংবা তার কাছে কোনো কল্যাণ বা নেয়ামত পেতে হলে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। যা দোয়াকারী বা প্রার্থনাকারীর জন্য অবশ্য পালনীয়। হাদিসে আল্লাহর কাছে দোয়া করার ক্ষেত্রে দুইটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
‘হযরত আবূ সাঈদ খুদরি (রাঃ) হতে প্রাপ্ত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ একজন মুসলমান যখন অন্য কোনো মুসলমানের জন্য দোয়া করে, যার মধ্যে কোনোরূপ গোনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা থাকে না; আল্লাহ তায়ালা এ দোয়ার বিনিময়ে তাকে ৩টির যেকোনো একটি দান করে থাকেন-
১)তার দোয়া দ্রুত কবুল করে থাকেন;
২) তার প্রতিদান আখেরাতে দেয়ার জন্য রেখে দেন; কিংবা
৩) তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূর করে দেন।
নামাজে যে যে স্থানে দোয়া করা যায়
১ম স্থান – তাকবিরে তাহরিমার পর।
২য় স্থান – সিজদা তে।
৩য় স্থান – শেষ বৈঠকে। নামাজে সালাম ফেরানোর আগে।
নামাজে সালাম ফিরানোর আগে দোয়া পড়ার পক্ষে দলিল –
ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিস: নবীজি (সাঃ) তাদেরকে তাশাহ্হুদ শিক্ষা দিতেন। এরপর তিনি হাদিসের শেষের দিকে বলেন: “এরপর যা ইচ্ছা প্রার্থনা করবে।”[সহিহ বুখারী (৫৮৭৬) ও সহিহ মুসলিম (৪০২)]
সেজদাতে ও শেষ বৈঠকের তাশাহ্হুদের পর দোয়া পড়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়ে থাকে।
হাফেজ ইবনে হাজার (রহঃ) হতে বর্ণিত,
নামাযে দোয়া করার স্থান হচ্ছে- সেজদা কিংবা তাশাহ্হুদ। ফাতহুর বারী (১১/১৮৬) থেকে সমাপ্ত; আরও দেখুন প্রাগুক্ত গ্রন্থের (২/৩১৮)
শাইখ বিন বাজ (রহঃ) বলেন:
নামাযে থাকাকালীন দোয়া করার স্থানসমূহ হলো: সিজদা ও আত্তাহিয়্যাতু শেষে সালাম ফেরানোর পূর্বে। মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বাজ (৮/৩১০)
তবে নামাজের মধ্যে আপন আপন ভাষায় দোয়া করা যাবে না। এমনকি আরবিতেও নিজের বা কারো বানানো দোয়া পড়া যাবে না। শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নায় বর্ণিত দোয়া পড়তে হবে।
নামাজে সালাম ফিরানোর আগে যে দোয়াগুলো পড়তে পারেন –
নামাজের শেষ বৈঠকে নবীজি (সাঃ) বিভিন্ন ধরনের দোয়া পাঠ করতেন যেগুলো আমরা হাদিসের আলোকে জানতে পেরেছি।আমাদের সকলের উচিৎ উক্ত দোয়া গুলো পড়া এবং দোয়ার মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের ফায়দা হাসিল করা।
১) হজরত আয়েশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) নামাজে এ বলে দোয়া করতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْمَأْثَمِ وَالْمَغْرَمِ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজা-বি ঝাহান্নাম ওয়া আউজুবিকা মিন আজা-বিল ক্ববর, ওয়া আউজুবিকা মিং ফিতনাতিল মাসীহিদ দাঝঝা-ল, ওয়া আউজুবিকা মিং ফিতনাতিল মাহ্ইয়া ওয়াল মামা-ত, আল্লা-হুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল্ মা’ছামি ওয়া মিনাল মাগরাম।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আজাব থেকে, মাসিহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে এবং জীবন ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! গুনাহ ও ঋণগ্রস্ততা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।’
একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ঋণের ব্যাপারে (আল্লাহর কাছে) এত বেশি আশ্রয় চান কেন? জবাবে নবিজী বললেন, ‘মানুষ যখন ঋণে জড়িয়ে পড়ে, তখন কথা বললে মিথ্যা বলে আর ওয়াদা দিলে তা ভঙ্গ করে।’ (বুখারি)
২) اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ وَمَا أَسْرَفْتُ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّي أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম মাগফিরলি মা ক্বাদ্দামতু ওয়া মা আখখারতু ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আলানতু ওয়া মা আসরাফতু ওয়া মা আন্তা আলামু বিহি মিন্নি আন্তাল মুক্বাদ্দিমু ওয়া আন্তালমুওয়াখখিরু লা ইলাহা ইল্লা আন্তা।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার আগের ও পরের সব গোপন ও প্রকাশ্য গোনাহ ক্ষমা কর (এবং ক্ষমা কর সেসব গোনাহ) যাতে আমি বাড়াবাড়ি করেছি। আর সেসব গোনাহ যে বিষয়ে তুমি আমার চেয়ে বেশি জান। তুমি আদি, তুমি অনন্ত। তুমি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোনো মাবুদ নেই। (মুসলিম)
আরো দলিল
৩) বেশিরভাগ মানুষ সালাম ফিরানোর আগে যে দোয়াটি বেশি পড়ে;
اَللَّهمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كثِيرًا، وَلَا يَغْفِر الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ، فَاغْفِر لِي مَغْفِرَةً مِّن عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيم
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমাং কাছিরাও ওয়া লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আংতা ফাগফিরলি মাগফিরাতাম মিন ইংদিকা ওয়ারহামনি ইন্নাকা আংতাল গাফুরুর রাহিম।
যার অর্থ – হে আল্লাহ! আমি নিজের ওপর অত্যধিক অন্যায় করেছি এবং পাপ ক্ষমা করার কেউ নেই একমাত্র তুমি ছাড়া। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা একমাত্র তোমার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে এবং আমার প্রতি দয়া করো। নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
পরিশেষে
আল্লাহতালা মুসলিম উম্মাহকে নামাজের শেষ বৈঠকে কুরআন হাদিস নির্দেশিত দোয়া পাঠ করার তৌফিক দান করুন। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন।