আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ্। সমস্ত প্রশংসক মহান আল্লাহ্ তাআলার, যিনি সব কিছুর স্রষ্টা এবং একমাত্র সত্য মা’বূদ। দুরূদ ও সালাম বরষিত হোক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। যাকে আল্লাহ্ তাআলা প্রেরণ করেছেন মানবজাতির হিদায়াতের জন্য। আমাদের উপর দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরয। যাতে রয়েছে মোট ১৭ রাকআত নামাজ। এছাড়া রয়েছে সুন্নাতে রাতেবা ১২ রাকআত ও বিতরের নামাজ। বেতের নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও ফজীলত নিয়ে আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি।
বেতের নামাজের নিয়ত
বেতের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট পঠনীয় কোন নিয়ত নেই। কোন নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়লে তা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে। বেতের নামাজের নিয়ম হলো প্রথমে মনে মনে নিয়ত করা আর এটাই হলো সুন্নাহসম্মত নিয়ম।
নিয়ত বলতে মনের সংকল্প বুঝায়। যত রাকআত বেতেরের নামাজ পড়ার জন্য মনস্থির করা হবে, সে অনুযায়ী মনে মনে নিয়ত করতে হবে।
বেতের নামাজের নিয়ম
বিতরের নামাজ আদায়ের কয়েকটি নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে ৩ রাকআত বিতর তিনভাবে পড়ার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও ৫/৭/৯ রাকআত বেতেরও পড়া যায়। বেতেরের নামাজ সর্বনিম্ন ১ রাকআত। আমরা ১ রাকআত ও ৩ রাকআত বিশিষ্ট বেতের নামাজের নিয়ম জানবো ইনশা আল্লাহ্।
১ রাকআত বেতের নামাজের নিয়ম
মুআবিয়া রাদ্বিআল্লহু আনহু হতে বিশুদ্ধ সূত্রে ১ রাকআত বেতের নামাজ সম্পর্কে জানা যায়। এক রাকআত বেতের নামাজের নিয়ম হলো – প্রথমে মনে মনে নিয়ত করে আল্লহু আকবার বলে হাত বাঁধবে।
তারপর সূরা ফাতিহা ও সূরা ইখলাস পড়বে। এরপর রুকুর আগে বা পড়ে দুআয়ে কুনূত পড়বে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে কুনূতের পরিবর্তে কুনূতে নাযেলা পড়ে, যা সঠিক নয়।
আপনি দুআয়ে কুনূত সেটাই পড়বেন, যেটা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ থেকে বিশুদ্ধভাবে আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। এক্ষেত্রে শাইখ আবুবকর যাকারিয়া এর অনুবাদকৃত ‘হিসনুল সুসলিম’ বইটি দেখতে পারেন।
দুআয়ে কুনূত পড়া হলে রূকু না করে থাকলে রূকু করবেন। আর রুকু করে থাকলে সিজদাহতে চলে যাবেন। অতঃপর সিজদাহ শেষ হলে বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দুরূদ ও অন্যান্য সুন্নাহসম্মত দুআগুলো পড়বেন। এরপর সালাম ফিরিয়ে বেতের নামাজ সম্পূর্ণ করবেন।
৩ রাকআত বেতের নামাজের নিয়ম
প্রথম নিয়ম:
অন্যান্য সালাতের মতো প্রথমে দুই রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেবেন। অতঃপর পৃথকভাবে আরেক রাকআত পড়ে রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়ে সিজদা শেষে আবার বসে সালাম ফিরাবেন। (সহীহ্ মুসলিম: ১২৫২) তবে দু’আ কুনুত পড়ার আগে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা ও তাকবীরে তাহরীমার মতো দুই হাত উঠানোর কোন বিধান নেই।
দ্বিতীয় নিয়ম:
অন্যান্য নামাজের মতোই প্রথম ও দ্বিতীয় রাকআত পড়বেন। তবে দ্বিতীয় রাকাআতের পর তাশাহহুদের জন্য না বসে সরাসরি দাঁড়িয়ে যাবেন।
তৃতীয় রাকআতে কিরাআত পাঠ শেষে দু’আ কুনূত পড়ে রুকুতে চলে যাবেন অথবা কিরাআত পাঠের পর রুকু দিয়ে আবার উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুআ কুনুত পড়ে একেবারে সিজদাহয় চলে যাবেন।
শুধুমাত্র তৃতীয় রাকআতের পর বসবেন এবং আত্তাহিয়্যাতু (তাশাহহুদ), দুরূদ ও দুআয়ে মাসূরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেবেন। এখানেও দু’আ কুনূতের শুরুতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে দু হাত ওঠানোর কোন নিয়ম নেই।
আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিআল্লহু আনহা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩ রাকাআত বেতেরের নামাজ আদায় করতেন। এর মাঝে তাশাহহুদের জন্য বসতেন না। একাধারে তিন রাকআত পড়ে শেষ রাকআতে বসতেন ও তাশাহহুদ পড়তেন। এভাবে উমার রাদ্বিআল্লহু আনহুও বিতর পড়তেন। (মুসতাদরাক হাকিম: ১১৪০)
তৃতীয় পদ্ধতি:
এ পদ্ধতিটি আমাদের দেশে খুব প্রচলিত। এ পদ্ধতিতে ২য় রাকআত শেষে বসে তাশাহহুদ পড়া হয়।
(১) বিশ্বের খ্যাতনামা আলেম ভারতের আল্লামা সফীউর রহমান মুবারকপুরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নিয়মে বেতের নামাজ পড়েছেন মর্মে কোন সহীহ্ হাদীস পাওয়া যায় না।
(২) মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি. গবেষকদের উস্তায ড. ফাইহান শালী আল মুতাইরী বলেছেন, নাবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর সাহাবাদের কেউই এ পদ্ধতিতে বেতের নামাজ পড়েছেন – এ মর্মে কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ নেই।
(৩) ‘যাদুল মাআদ কিতাবে ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেতের নামাজ পড়ার ৫টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
তন্মধ্যে, আমাদের মাঝে প্রচলিত পদ্ধতিটি আলোচনায়ই আনেননি। কেননা, এটা সহীহ্ হাদীসের পরিপন্থী। বরং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদ্ধতিতে বেতের পড়তে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
“তোমরা মাগরিবের নামাযের মতো করে তিন রাকআত বেতেরের নামাজ পড়ো না।” (দারাকুতনী: ১৬৫০, পৃষ্ঠা ২/৩৪৪, সহীহ ইবনু হিব্বান: ২৪২৯)। আর মক্কা ও মদীনার মসজিদগুলোতে ১ম ও ২য় পদ্ধতিতে বিতর পড়ে থাকে, কিন্তু ৩য় পদ্ধতিতে বিতর পড়তে কখনো দেখা যায়নি।
বেতের নামাজের ফজিলত
আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে থাকলেও কখনো ফজরের ২ রাকআত সুন্নাত ও বেতেরের নামাজ ত্যাগ করতেন না। এই বিষয় দ্বারা বেতের নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করা যায়।
বেতের নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। অর্থাৎ, গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এই নামাজ আমাদেরকে নিয়মিত আদায় করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করা যাবেনা। তবে মাঝেমধ্যে কোন কারণে বাদ গেলে সমস্যা নেই। কোনক্রমেই নিয়মিতভাবে বেতের নামাজ বাদ দেয়া যাবেনা।
যতি বেতের নামাজ ছুটে যায় কোনদিন, তাহলে পরবর্তীতে জোড়সংখ্যায় তার ক্বাযা আদায় করতে হবে। যেমনঃ কেউ নিয়মিত ১ রাকআত বেতের নামাজ পড়ে, তার এ নামাজ যদি ওয়াক্ত পার হয়ে ছুটে যায়, তাহলে দিনের বেলা ২ রাকআত বেতের ক্বাযা আদায় করবে।
এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে, বেতের নামাজে দুআয়ে কুনূত সবসময় পড়া জরুরি নয়। দুআয়ে কুনূত ছাড়াও বেতের নামাজ পড়া যাবে, এতে কোন অসুবিধা নেই। দুআ কুনূত ছাড়া বেতের নামাজ হবেনা – এ ধারণা সঠিক নয়।
আমরা আজকে বেতের নামাজের নিয়ম জেনে নিলাম নিয়ত ও ফজিলতের বিষয়সহ। মহান আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে সঠিক দ্বীনি জ্ঞানার্জন করার তাওফীক দান করুন এবং হিদায়াতের পথে অটল অবিচল রাখুন। আমীন ইয়া রব।