সূর্যমুখী ফুল চাষ : পদ্ধতি, খরচ ও লাভ | সূর্যমুখী ফুল চাষ কিভাবে করবো?

0
41
সূর্যমুখি ফুল চাষ পদ্ধতি

দেখতে সূর্যের মতো হলুদ বর্ণের সুন্দর একটি ফুল হলো সূর্যমুখী ফুল। দেখতে দারুণ এই ফুলটি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য উপকারী। আজকের এই আর্টিকেলে সূর্যমুখী ফুল চাষ এর ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো। 

 

আমরা আমাদের খাদ্য তালিকায় সয়াবিন অথবা সরিষার তেল বহুল ব্যবহার করে থাকি। অথচ এসব তেল আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সূর্যমুখী ফুল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি ও ই; যা শরীরের জন্য দরকারী।

 

তাছাড়া সয়াবিন উৎপাদন হতে যেখানে ১৩০ দিনের মতো লাগে; সূর্যমুখী ফুল এর তেল উৎপাদন হতে লাগে ১০০ দিনের মতো। এর পাশাপাশি সূর্যমুখী ফুল এর বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে সূর্যমুখী ফুল চাষ হচ্ছে। যশোর, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, দিনাজপুর সহ অনেক জেলাতে সূর্যমুখী ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। এই লাভজনক শস্যটির চাষপদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে চলুন জেনে নেয়া যাকঃ

সূর্যমুখী ফুল চাষের পদ্ধতি 

 

সূর্যমুখী ফুল চাষ করা জন্য ধারাবাহিকভাবে কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি। সেগুলো নীচে ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলোঃ

সূর্যমুখী ফুল চাষের উপযুক্ত সময় এবং জমি

 

সূর্যমুখী ফুল হলো ৬ মাসি একটি ফসল। এটি বপনের উপযুক্ত সময় হলো কার্তিক ও অগ্রহায়ন মাস। তবে জৈষ্ঠ্য মাসেও এই শস্য চাষ করা যায়। সূর্যমুখী ফুল চাষের জন্য পানি জমে থাকে না – এমন যে কোন জমি উপযুক্ত। তবে দোআঁশ মাটিতে এর ফলন ভালো হয়।

সূর্যমুখী ফুলের জাত

 

১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশে সূর্যমুখী ফুল চাষ হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত সূর্যমুখীর ৩টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – কিরণী (ডিএস – ১)। ১৯৯২ সালে জাতটির অনুমোদন দেয়া হয়।

 

এই জাতটির কান্ডের ব্যাস হলো দেড় থেকে দুই সেন্টিমিটার। পরিপক্ক পুষ্পমঞ্জুরি বা শাখার ব্যাস হলো ১২ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৬০০ এর মতো। এই জাতের বীজগুলো কালো বর্ণের হয়ে থাকে।

 

প্রতি ১০০০টি বীজের ওজন গড়ে ৬৮-৭২ গ্রামের মতো। এই জাতের বীজ থেকে প্রায় ৪৪ শতাংশের মতো তেল পাওয়া যায়। এর জীবনকাল ৩ মাস থেকে প্রায় ৪ মাসের কাছাকাছি পর্যন্ত হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি গড় ফলনের পরিমাণ ১.৫ থেকে ১.৮ টন এর মত।

চাষের জন্য মাটি তৈরি

 

সূর্যমুখী ফুলের চাষের জন্য জমিকে গভীরভাবে আড়াআড়ি পদ্ধতিতে চাষ দিয়ে নিতে হবে। ৫-৬ বার চাষ দেয়ার পর মই দিয়ে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে হবে। এছাড়াও কোনরূপ চাষ ছাড়াই ডিবলিং পদ্ধতিতেও সূর্যমুখী ফুল চাষ করা যায়।

কিভাবে বীজ বপন করবেন?

 

আপনি যদি বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী ফুল চাষ করতে চান, তাহলে তাহলে সারি পদ্ধতিতে চাষ করতে পারেন। এক বিঘা জমির জন্য মাত্র এক কেজি বীজই যথেষ্ট। সারাবছরই বীজ বপন করা যায় তবে নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় বপন করলে বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।

সারি সারি করে বীজ বপন করার সময় নির্দিষ্ট দূরত্বে দুইটি করে বীজ বুনবেন। দুইটি করে বীজ বপনের কারণ হলো – একটি বীজ যদি নষ্টও হয়ে যায়, তাহলে যেন অন্য বীজটা থাকে। কারণ, বীজশূণ্য হয়ে গেলে সারি ফাঁকা হয়ে যেতে পারে।

যদি দুইটি বীজেই ফলন হয়, তাহলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল চারাটি ফেলে দিয়ে সবল চারাটি রাখতে হবে। 

সার প্রয়োগ

 

এক বিঘা বা ৩৩ শতাংশ জমিতে নির্দিষ্ট হারে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, বোরিক অ্যাসিড, জিপসাম ও জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে।

 

খেয়াল রাখবেন যে, সূর্যমুখী ফুল চাষে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যাবে না; বরং জৈব সার বেশি এবং রাসায়নিক সার কম পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে। সাধারাণত, সার ২টি সময়ে প্রয়োগ করতে হয়। একবার চারা জন্মানোর ২০ দিন পর এবং আরেকবার তার ৪০ দিন পর।

সেচ দেয়া

 

সূর্যমুখী ফুলের বাগানে মাত্র এক অথবা দুই সেচেই ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে আপনি যদি বেশি ফলন প্রত্যাশা করে থাকেন, তাহলে এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর কয়েকটা সেচ দিতে হবে।

 

প্রথমবার সেচ দিতে হবে বীজ বপন করার ৪ সপ্তাহ পর ফুল ফোঁটার আগে। এরপর দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ৮ সপ্তাহ পর ফুল বা পুষ্পস্তবক গঠনের সময়। আর তৃতীয় সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ১০ সপ্তাহ পর বীজ হৃষ্টপুষ্ট হবার পূর্বে। সেচের পানি যেন জমিতে জমে না থাকে সেটা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।

নিড়ানি দেয়া ও আগাছা দমন

 

চারা গজানোর ৩ সপ্তাহ পর প্রথমবার এবং চারা গজানোর ৭ সপ্তাহ পর দ্বিতীয়বার সূর্যমুখীর গাছ গুলোকে নিড়ানি দিতে হবে এবং আগাছা কেটে পরিষ্কার করতে হবে।

 

একই জায়গায় যদি অনেকগুলো গাছ জন্মে গোছা হয়ে যায়; তাহলে একটি পুষ্ট গাছ রেখে বাকি গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে। এভাবে সারি সারি করে বাগান সাজাতে হবে।

 

সূর্যমুখী ফুল গাছের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার

 

সূর্যমুখী ফুল গাছের বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – শিকড় পঁচা এবং পাতা ঝলসানো রোগ। এছাড়া বিছাপোকার আক্রমণের কারণেও সমস্যা হয়ে থাকে। এসব রোগ ও সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য আপনাকে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

 

শিকড় পঁচা রোগ হলো এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণের কারণে গাছের গোড়ায় ছোট গোলাকার দানার মত সাদা তুলার ন্যায় দেখা যায়। এর ফলে গাছ ঝিমিয়ে যায় এবং শুকিয়ে একটা সময় মারা যায়। Provex 200 ওষুধ দ্বারা বীজ শোধন করার মাধ্যমে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

 

এছাড়া গাঢ় বাদামি অথবা ধূসর বর্ণের একটা দাগ পড়ে সূর্যমুখীর পাতায়। এ দাগ আস্তে আস্তে বড় হতে হতে একটা সময় সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়; যা পাতা ঝলসানো রোগ নামে পরিচিত। এ রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য রোভরাল ফিফটি ডাব্লিউপি ২% হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর দিলে সমস্যা কমে যায়।

 

এছাড়া আরও বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এজন্য সূর্যমুখীর বাগানে যেন কোনমতেই পানি জমে না থাকে এবং স্যাঁতস্যাঁতে ভাব না থাকে; তা খেয়াল রাখতে হবে। এর পাশাপাশি অভিজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রায় বিভিন্ন কীটনাশক ও ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

সূর্যমুখী ফুল চাষের জন্য খরচের পরিমাণ

 

এক বিঘা জমিতে বীজ ক্রয়, চারা রোপণ, পরিচর্যা এবং সার কীটনাশক সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকার মতো প্রয়োজন। আপনার যদি জমির পরিমান আরও বেশি হয় তাহলে এই অনুপাতে সূর্যমুখী ফুল চাষের খরচ ধরে নিতে পারেন। যেমনঃ ৫ বিঘা জমির জন্য (১২,০০০x ৫) = ৬০,০০০/- টাকা খরচ।

 

সূর্যমুখী ফুল চাষ কি লাভজনক?

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সূর্যমুখী ফুল চাষ লাভজনক। এই শস্যটি বছরে ১ বার করে চাষ করা যায়। বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষেরা খাদ্য সচেতন হয়ে উঠছে দিনদিন। তারা এখন স্বাস্থ্যকর খাদ্য সংগ্রহ করার প্রতি মনোযোগী।

 

তাই ক্ষতিকারক সয়াবিন ও সরিষার তেলের বিকল্প হিসেবে সূর্যমুখীর তেল কেনার ব্যাপারে তাদের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে আমাদের বাজারে সূর্যমুখীর তেল না থাকায় সে অনুপাতে মানুষ তা কিনতে পারে না। মানুষের এ চাহিদা বিবেচনায় সূর্যমুখী ফুল চাষ নিঃসন্দেহে লাভজনক।

 

এছাড়াও স্বাস্থ্যগত উপকারীতা বিবেচনায়ও এটি লাভজনক। কেননা, সূর্যমুখীর তেল হৃদরোগীদের জন্য উপকারী এবং ঘিয়ের বিকল্প হিসেবে সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা যায় যা বনস্পতি তেল নামে পরিচিত।

 

আর সূর্যমুখী ফুল চাষ করতে যে যে বিষয় দরকার হয়; যেমনঃ উপযোগী জমি, সেচ ব্যবস্থা সহ ইত্যাদি; তা অনেকটাই অনুকূলে। সূর্যমুখীর বাগানে মধ্যে বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদী শাকসবজি চাষ করা যায়। সবকিছু মিলিয়ে সূর্যমুখীর চাষ লাভজনক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

ইতিকথা

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক এবং স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় সূর্যমুখী ফুল চাষ সময়োপযোগী এবং লাভজনক একটি শস্য হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি – এটি চাষের জন্য উপযোগী।

এছাড়া এই শস্য চাষ করতে তেমন বড় অঙ্কের মূলধন লাগে না; ফলে যাদের নিজস্ব জমি রয়েছে, তারা সহজেই অল্প মূলধন বিনিয়োগে সূর্যমুখী ফুল চাষ শুরু করতে পারেন। মানুষের চাহিদাকে যথাসম্ভব পূরণ করতে পারলে সূর্যমুখী ফুল চাষ আরো বেগবান হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

 

Visited 25 times, 1 visit(s) today

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here