উচ্চতা অনুযায়ী প্রত্যেক সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ওজনের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই (BMI) নামে পরিচিত। স্বাভাবিক বিএমআই ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৯ এর মধ্যে হওয়া উচিত। বিএমআই কম হলে আন্ডারওয়েট এবং বেশি হলে ওভারওয়েট হিসেবে ধরা হয়। উভয় অবস্থাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
যদি দেখা যায়, আপনার শারীরিক ওজন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে এবং তা স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের মধ্যেও হচ্ছে, তবে এটি চিন্তার বিষয় হতে পারে। আকস্মিক ওজন হ্রাসের কারণগুলো এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে জানতে হলে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
হঠাৎ ওজন কমে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো
১. হাইপারথাইরয়েডিজম: হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণে শরীরে বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায় এবং দ্রুত ওজন কমতে থাকে। এই অবস্থায় হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, উদ্বেগ, ঝাঁকুনি বা কাঁপুনি এবং অনিদ্রার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত ঘাম, ডায়রিয়া, এবং গরম অসহ্য লাগার মতো উপসর্গও দেখা যায়।
২. অন্ত্রের রোগ: সিলিয়াক ডিজিজ, ক্রোনস ডিজিজ, এবং ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা অন্ত্রের পুষ্টি শোষণে বাধা সৃষ্টি করে। এটি ম্যালাবসোরপশন ঘটায়, ফলে ওজন দ্রুত কমে যেতে পারে। সিলিয়াক ডিজিজে গ্লুটেনমুক্ত ডায়েট অনুসরণ করলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
৩. ক্যানসার: গ্যাস্ট্রিক এবং অগ্ন্যাশয় ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের কারণে ওজন দ্রুত কমতে পারে। বিশেষত, পাকস্থলী, কোলন, ফুসফুস, মাথা এবং ঘাড় ক্যানসারের জন্য এই উপসর্গটি খুবই সাধারণ। ক্যানসার শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরের পুষ্টি শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে ওজন কমতে শুরু করে।
৪. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত ব্যাধি, যা শরীরের জয়েন্টগুলোকে প্রভাবিত করে। প্রদাহ এবং শক্তি ব্যয়ের কারণে ওজন কমে যায়। প্রো-ইনফ্লেমেটরি সাইটোকাইনগুলো এই প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং শরীরের ক্যালোরি এবং চর্বি পোড়ায়, ফলে ওজন কমতে থাকে।
৫. ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে ওজন কমতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বারবার পানি পিপাসা লাগা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, এবং বেশি ক্ষুধা লাগা স্বাভাবিক। এই উপসর্গগুলির কারণে ধীরে ধীরে ওজন কমতে শুরু করে।
৬. মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের কারণে ওজন কমে যেতে পারে। কাজের চাপ বা ব্যক্তিগত জীবনে মানসিক চাপ থেকে বের হতে না পারলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার কারণে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হতে পারে, ফলে ওজন কমতে থাকে।
ওজন কমার সাথে অন্যান্য লক্ষণ
- ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিসের কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব, পিপাসা এবং ক্ষুধা বেড়ে যায়। এটি শরীরের শক্তি ব্যবহার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটায়, ফলে ওজন কমে যেতে পারে।
- হাইপারথাইরয়েডিজম: গরম অসহ্য লাগা, ভীষণ ঘাম হওয়া, ডায়রিয়া এবং অস্থিরতার মতো উপসর্গ দেখা যায়। এই উপসর্গগুলির ফলে শরীরের ওজন কমতে শুরু করে।
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: জয়েন্টগুলিতে ব্যথা এবং প্রদাহ দেখা যায়, যা শরীরের ক্যালোরি এবং চর্বি পোড়ায়, ফলে ওজন কমে যায়।
হঠাৎ ওজন কমে গেলে করণীয় পদক্ষেপ
চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন যদি আপনার ওজন হঠাৎ করেই কমে যায় এবং কোনো সুস্পষ্ট কারণ না থাকে, তবে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, এমনকি ক্যানসারও।
সুষম খাদ্য গ্রহণ অধিক আঁশযুক্ত খাবার, টাটকা শাকসবজি, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। এসব খাদ্য ক্যানসার প্রতিরোধেও সহায়ক হতে পারে। ফলমূল, লাল আটা ও চাল, শস্যদানা, কমলা, টমোটো ইত্যাদি খাবার অন্ত্রনালি ও পায়ুপথ ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
নিয়মিত ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। হাঁটা একটি ভালো ব্যায়াম হতে পারে। অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য এড়িয়ে চলুন। ব্যায়াম শরীরের বিপাকক্রিয়া বাড়ায় এবং শরীরের পুষ্টি শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ দূর করতে মনোবিজ্ঞানের পরামর্শ নিন। সঠিক বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। মানসিক চাপ কমানোর জন্য যোগব্যায়াম বা ধ্যান করতে পারেন। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন এবং ওজনের পরিবর্তনগুলি নজরে রাখুন। যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অভ্যাস বজায় রাখুন। স্বাস্থ্যকর খাবার খান, যথেষ্ট বিশ্রাম নিন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
উপসংহার
উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকস্মিক ওজন হ্রাস শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি বিভিন্ন গুরুতর রোগের লক্ষণ হতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অভ্যাস বজায় রাখার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সবার সুস্থ জীবন কামনা করি। সুস্থ্যতা ও শরীর বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যের জন্য বাংলা আলো ওয়েবসাইটের স্বাস্থ্য টিপস নামক ক্যাটাগরিটি অনুসরণ করুন।