নামাজে ভুল হলে করণীয়। সাহু সিজদার নিয়ম (দলিল সহ ব্যাখ্যা)

0
19
নামাজে ভুল হলে করণীয়। সাহু সিজদার নিয়ম (দলিল সহ ব্যাখ্যা)

নামাজ হলো আল্লাহ’তালার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি শ্রেষ্ঠ ফরজ বিধান বা ইবাদত। নামাজকে মুমিনের মেরাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেক সময় শয়তানের প্ররোচনায় অথবা খেয়ালের ভুলে নামাজে অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাদের কিছু ভুল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে নামাজে ভুল হলে করণীয় হলো সাহু সিজদাহ্ দেওয়ার মাধ্যমে নামাজ বিশুদ্ধ করে নেওয়া।

 নামাজে ভুল হওয়ার কারণ

ভুল হওয়া মানুষের জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার।মানুষ মাত্রই ভুল করে। তাছাড়া শয়তান প্রতিনিয়তই মানুষের ভালো কাজে বাধা প্রদান করে থাকে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) থেকেও নামজে অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। তাই যখনই  নামাজে তাঁর অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে তখনই তিনি বলতেন-‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তোমরা যেমন ভুলে যাও আমিও তেমন ভুলে যাই। সুতরাং যদি আমি ভুলে যাই, তাহলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

 কিভাবে নামাজ আদায় করলে ভুল কম হবে?

নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরয তথা অপরিহার্য ইবাদত। সহীহ শুদ্ধভাবে যথাযথ নিয়ম মেনে একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করাই নামাজের মূল লক্ষ্য। আর নামাজে যথাসম্ভব ভুল এড়িয়ে একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করার অন্যতম উপায় হলো খুশু-খুজু নিয়ে নামাজ আদায় করা।

শরিয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হল অন্তরে বিনয় ও স্থিরতা থাকা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনাকে অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থিত না করা এবং অঙ্গপ্রতঙ্গকে স্থির রাখা, সেগুলোকে অযথা নাড়াচাড়া না করা (বয়ানুল কুরআন)।

 নামাজে ভুল হলে করণীয় বিষয় কি কি?

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজ পালনে মুমিন সর্বাধিক সর্তকতা অবলম্বন করবে। নামাজের ফরজ,ওয়াজিব এবং সুন্নাত যথাযথ ভাবে পালন করবে। নামাজের মধ্যে ১৪টি ওয়াজিব রয়েছে। উক্ত ওয়াজিবগুলোর থেকে যদি নামাজ আদায়কালীন সময়ে যেকোন একটি ওয়াজিবও ছুটে যায় তবে নামাজ বিশুদ্ধ করার জন্য শেষ বৈঠকে অতিরিক্ত দুইটি সিজদা আদায় করতে হয় যাকে সাহু সিজদা বলা হয়ে থাকে। আমরা অনেকেই সাহু সিজদা আদায়ের নিয়ম জানি না । এই কারণে নামাজে ভুল হলে শুদ্ধ করে নিতে পারি না। তাই আমাদের সবার-ই সাহু সিজদা কি?কখন সাহু সিজদা আদায় করতে হয়? এই বিষয়গুলো জেনে রাখা একান্ত আবশ্যক।

যে ৩টি কারণে নামাজে সাহু সিজদা দিতে হয়

১) নামাজের রুকন বা ওয়াজিব ছুটে গেলে

২) নামাজে ভুল হয়েছে এমন সন্দেহ হলে

৩)রুকু বা সিজদা বেশি দেওয়া

১) নামাজের রুকন বা ওয়াজিব ছুটে গেলে :

ওয়াজিব কাজ ভুলে গেলে অর্থাৎ চার রাকাত নামাজের মধ্যে দুই রাকাত নামাজের বৈঠক করা ভুলে গেলে সাহু সেজদাহ দিতে হবে। সুরা ফাতেহার পর অন্য কোন সূরা পাঠ করা ওয়াজিব। ভুলক্রমে অন্য কোন সূরা পাঠ না করলে আপনাকে সাহু সিজদা দিতে হবে। সূরা ফাতেহা পড়ার পর এখন কী সূরা পড়বো- এ চিন্তায় যদি ৩ তসবীহ পরিমাণ সময় চলে যায় তাহলে সিজদায়ে সাহু করতে হবে। অথবা কোনো সূরার কোনো আয়াত ভুলে গেছেন ওই আয়াত স্মরণ করার জন্য যদি ৩ তাসবীহ পরিমাণ সময় চলে যায় তাহলে সিজদায়ে সাহু করতে হবে।

২)নামাজে ভুল হয়েছে এমন সন্দেহ হলে :

কোনো কারণে সালাতের ওয়াজিব ও রোকনের ক্ষেত্রে সন্দেহ তৈরি হলে, তখন এই সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি ইয়াকিনের ওপর নির্ভর করবেন। যেমন : তৃতীয় রাকাত আদায় করেছেন নাকি দ্বিতীয় রাকাত আদায় করেছেন এমন সন্দেহ তৈরি হলে। তখন তিনি দ্বিতীয় রাকাত ধরে নিয়ে তৃতীয় রাকাত নিশ্চিত করবেন এবং সাহু সিজদাহ দেবেন।

হজরত ইয়াজ ইবনে হিলাল বর্ণনা করেন আমি হজরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললাম, আমাদের কারো যদি খেয়াল না থাকে যে, সে কতটুকু (রাকাআত) নামাজ আদায় করল, তবে সে কী করবে?

হজরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললাম, নবীজী (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো নামাজ আদায়কালে যদি কত রাকাআত পড়েছে, সে খেয়াল না থাকে, তবে সে (শেষ বৈঠকে) বসা অবস্থায় দুই সেজদা (সাহু) দেবে।’ (তিরমিজি) 

তবে নামাজের সালাম ফেরানোর পর স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করার পর যদি রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে উক্ত নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। এই নামাজ আবার পড়তে হবে। (ইবনে আবি শায়বা : ২/২৮)

৩) রুকু বা সিজদা বেশি হলে :

নামাজ যদি অতিরিক্ত হয়ে যায় অর্থাৎ চার রাকাত নামাজ যদি পাঁচ রাকাত বা ছয় রাকাত হয়ে যায়, নামাজের রুকু সেজদাহ যদি বেশি দিয়ে ফেলেন তাহলে সাহু সেজদাহ দিতে হবে। 

হাদিসে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কারো যদি এক রাকাআত না দুই রাকাআত (নামাজ পড়েছ) এ বিষয়ে সন্দেহ হয়, তবে এক রাকাআত ধরবে; আর যদি দুই রাকাআত না তিন রাকাআত এই বিষয়ে সন্দেহ হয়, তবে দুই রাকাআত ধরবে এবং এই কারণে সালাম ফেরনোর আগে দুই সিজদা (সাহু) আদায় করবে।

সাহু সিজদা দেওয়ার নিয়ম

সাহু অর্থ ভুলে যাওয়া। ভুলে নামাযের মধ্যে কিছু বেশী-কম হয়ে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেলে তা সংশোধনের জন্য নামাযের শেষ বৈঠকে দু’টি সিজদা করা ওয়াজিব হয় তাকে বলে সিজদায়ে সাহু।

 শেষ বৈঠকে  বসে আত্তাহিয়াতু পড়তে হবে। এরপর ডান পাশে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে সালাম ফেরাতে হবে। তারপর বাম পাশে সালাম না ফিরিয়ে আল্লাহু আকবার বলে দুইবার সিজদায় যেতে হবে। পুনরায় বৈঠকে বসে আত্তাহিয়াতু, দুরুদ শরীফ, দোয়া মাসুরা পড়তে হবে। এরপর আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে ডানপাশে একবার সালাম ফেরাতে হবে এবং বাম পাশে একবার সালাম ফেরাতে হবে।  এটি হলো সাহু সেজদাহের নিয়ম। (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত সালাত অধ্যায় সাহো অনুচ্ছেদ, ১১৮ নাম্বার হাদিস।)

 হানাফি মতে সাহু সিজদা দেয়ার নিয়ম হল শেষ রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়ে শুধু ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে দুই টি সিজদা দিতে হবে এবং ২ সিজদার মাঝখানে অবশ্যই ১ তাসবীহ পরিমান সময় সোজা হয়ে বসতে হবে। তারপর আবার আত্তাহিয়্যাতু, দুরুদ শরীফ ও দোয়া মাসুরা পড়ে নামায শেষ করতে হবে।

মুক্তাদির ভুলের কারণে কি ইমাম কে সাহু সিজদা দিতে হবে?

জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়া অবস্থায় মুক্তাদির নিজস্ব ভুলের কারণে ইমাম-মুক্তাদি কারও ওপরই সাহু সিজদা ওয়াজিব হয় না। বিখ্যাত তাবেয়ি ইবরাহিম নাখায়ি (রহ.) বলেন, ‘তুমি যদি ইমামের পেছনে ভুল করো; কিন্তু ইমাম যদি কোনো ভুল না করে, তাহলে তোমার ওপর সাহু সিজদা নেই। আর ইমাম ভুল করলে তোমার ভুল না হলেও ইমামের সঙ্গে তোমাকে সাহু সিজদা করতে হবে।’

নামাজে ইমামের ভুল হলে করণীয় কী? এক্ষেত্রে সাহু সিজদা দিতে হবে কি?

জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার সময় যদি ইমামের কোন ভুল ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ ইমাম যদি রুকু দিতে ভুল করে বা সেজদাহে ভুল করে। তাহলে পিছনে থাকা মুসল্লিদের মধ্যে একজনকে আল্লাহু আকবার বলে ইমামকে সতর্ক করে দিতে হবে। একে ‘লোকমা’ দেওয়া বলা হয়ে থাকে। সহীহ হাদীস মতে, ‘সুবাহানআল্লাহ’ বলে লোকমা দেওয়া উত্তম। এক্ষেত্রে শেষ বৈঠকে সাহু সিজদাহ দেওয়ার প্রয়োজন হবে।

“একদিন নবীজি (সাঃ) চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজে দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক না করেই দাঁড়িয়ে যান। ঐ সময় সাহাবায়ে কেরাম ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে লোকমা দিয়েছেন।” (নাসায়ি ১/১৩২) 

পরিশেষে কিছু কথা

নামাজ আল্লাহকে খুশি করার অন্যতম উত্তম ইবাদত। একনিষ্ঠ ভাবে এবং একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। তবুও যদি নামাজে ভুল হয়ে যায় তখন নামাজে ভুল হলে করণীয় বিষয়গুলো আদায় করে নিতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা আমাদের পূর্ণ মনোযোগী হয়ে খুশু-খুজুর সাথে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে বাংলা আলো ওয়েবসাইটের ইসলাম ক্যাটাগরিটি অনুসরণ করুন। ধন্যবাদ।

Visited 7 times, 1 visit(s) today

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here