বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান উপার্জনের প্রক্রিয়া হচ্ছে কৃষি। তাই জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কৃষি ব্যবসা অন্যতম
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আয়ের একটি বড় অংশ কৃষির মাধ্যমেই এসে থাকে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৃষিপণ্য হলো ধান। আর ধান চাষে আমরা বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম।
ব্যবসা হিসেবে কৃষি নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ব্যবসা। কৃষি একটি ব্যাপক বিষয়। কেননা, অনেক কাজ এই কৃষির আওতাভুক্ত। আমাদের আজকের জানার বিষয় হলো ১০টি কৃষি ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে।
কথা না বাড়িয়ে চলুন সেগুলো নেয়া যাকঃ-
কৃষি ব্যবসা কেন করবেন?
অন্যতম সেরা ১০টি কৃষি ব্যবসা সম্বন্ধে জানার পূর্বে কৃষি ব্যবসা কেন করবেন? – এ প্রশ্নের উত্তরটা আপনার জেনে রাখা উচিত। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে, শুধু গ্রামেই কৃষি ব্যবসা সম্ভব, শহরে নয়।
তাদের এ ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। শহরেও কৃষি ব্যবসা সম্ভব বেশ কিছু ক্ষেত্রে। কৃষি ব্যবসা কেন করবেন – এ প্রশ্নের উত্তর জানার মাধ্যমে এ কাজে অগ্রসর হলে আপনার জীবন পাল্টে যাবে ইনশা আল্লাহ্।
খাদ্য আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদার একটি। আর খাদ্যপণ্য উৎপাদন ভূমি থেকে হয় – যা কৃষির অন্তর্ভুক্ত। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এটি স্পষ্টত একটি চাহিদাসম্পন্ন বিষয়।
তাই কৃষি ব্যবসা করার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আয়ের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা প্রতিদিনই খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করে থাকি।
আমরা যদি মানুষের এ চাহিদা কৃষি ব্যবসা দ্বারা পূরণ করতে পারি, তাহলে নিজে সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ্। কেননা, আপনি নিজে কৃষি ব্যবসা করলে যদি সেখানে লোক নিয়োগ দেন কাজে, তাহলে কিন্তু বেকারত্বটাও লাঘব হয়।
কৃষি ব্যবসা আইডিয়া
অনেক ধরনের কৃষি ব্যবসা রয়েছে, যেগুলোর সাথে বিভিন্ন মানুষ জড়িত। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের কৃষি ব্যবসা দেখা যায়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ১০টি কৃষি ব্যবসা আইডিয়া সম্পর্কে নিচে তুলে ধরা হলোঃ-
গরু-ছাগল পালন
কৃষি ব্যবসার মধ্যে গরু ও ছাগল পালন অন্যতম সেরা একটি ব্যবসা। এর মাধ্যমে অল্প সময়ে বড় অঙ্কের অর্থ লাভ করা সম্ভব। কুরবানির ঈদের সময়ে প্রচুর বিক্রীর মাধ্যমে শুধুমাত্র এই সময়েই ব্যাপক লাভবান হন অনেকে।
গরু ও ছাগল থেকে ৩ ধরনের বস্তু পাওয়া যায়। আর তা হলো – মাংস, দুধ এবং চামড়া। বর্তমান বাজারে এ ৩টি বস্তুরই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
আপনি মাত্র ২টি গরু নিয়েও ফার্ম দিয়ে ব্যবসা করতে পারেন। আর ছাগলের ক্ষেত্রেও ২/৩ টি ছাগল নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। প্রথমে ছোট থেকে শুরু করাটা অধিক নিরাপদ।
ফার্ম কিভাবে দিবেন – এ বিষয় বিস্তারিত শেখার জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে কোর্স করতে পারেন। এছাড়া গুগল এবং ইউটিউবও সার্চ করতে পারেন।
মৌমাছি পালন
মধুর সাথে মৌমাছির সম্পর্ক রয়েছে, এই বিষয়টা প্রায় সবাই আমরা জানি। মধুর পুষ্টিগুণ প্রচুর। এটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি এবং বিভিন্ন রোগের জন্য শেফা।
আমাদের দেশে মধুর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ভেজাল মধুর কারণে মানুষ খাঁটি মধু খোঁজে কেনার জন্য। আপনি এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই কৃষি ব্যবসা করতে পারেন।
বাসাতেই মৌমাছির চাষ করা সম্ভব। বাড়ির খোলামেলা কোন জায়গা অথবা রুমের ভেতর বক্স পদ্ধতিতে মৌমাছি চাষ করা যায়। প্রতিটি বাক্সে প্রায় ২ থেকে ৪ লক্ষ মৌমাছি থাকতে পারে।
মধু পাওয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষাও করা লাগে না। অনেকসময় দ্রুতই মধু পাওয়া যায়। প্রতিটি বক্স থেকে প্রায় ৫ কেজির মতো মধু পাওয়া যায়। তাই মৌমাছি পালন করে খাঁটি মধুর উৎপাদন আপনি করতে পারেন সহজেই।
মাশরুম চাষ
ব্যাঙের ছাতা বলে মাশরুম একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। এটি এক প্রকার ছত্রাক জাতীয় গাছ। মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতা দেখতে একই রকম হলেও এদের মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।
সূর্যের আলোয় প্রাকৃতিকভাবে মাশরুম তেমনভাবে জন্মায় না। তাই প্রাকৃতিক মাশরুম খাবার জন্য কম পাওয়া যায়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মাশরুম প্রচুর উৎপাদন হয়।
পৃথিবীতে কয়েক হাজার প্রজাতির মাশরুম রয়েছে। তার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক প্রজাতির মাশরুম খাওয়ার জন্য উপযুক্ত।
খাবার উপযুক্ত প্রজাতির কিছু মাশরুম হলো – ওয়েস্টার মাশরুম, উড ইয়ার মাশরুম, বাটন মাশরুম, শিতাকে মাশরুম সহ ইত্যাদি।
মাশরুম চাষের একটি বড় সুবিধা হলো – এটি অনুর্বর পরিত্যাক্ত ভূমিতেও চাষ করা যায়। আপনি বাড়ির সামনে অল্প কিছু জমিতে অথবা বারান্দাতেও মাশরুম চাষ করতে পারেন।
মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূলধন বিনিয়োগ করে আপনিও মাশরুম চাষ শুরু করতে পারেন। তবে এই কৃষি ব্যবসা শুরু করার পূর্বে মাশরুম ইন্সটিটিউট থেকে আপনাকে প্রশিক্ষন নিতে হবে অবশ্যই।
পোল্ট্রি ফার্মিং
মুরগীর মাংস এবং ডিমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের রুটিনে ডাক্তাররা ডিস সাজেস্ট করে থাকেন। এছাড়াও যারা জিমে ট্রেইনার, তারাও ডিম খেতে বলেন।
কেননা, এতে রয়েছে প্রোটিন, যা মানবদেহের জন্য খুব উপকারী। কৃষি ব্যবসা গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম লাভজনক একটি ব্যবসা। কারণ, মুরগীর মাংস ও ডিমের চাহিদা অনেক।
মাত্র ৫০,০০০/- টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে পোল্ট্রি ব্যবসা করতে পারেন। ছোট আকারে পোল্ট্রি ব্যবসার জন্য ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ; মাঝারি আকারের জন্য ৩ থেকে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা মূলধন দরকার হয়।
আর বড় আকারের পোল্ট্রির জন্য ৭ থেকে ১০ লক্ষ টাকা মূলধন দরকার হয়। আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী পোল্ট্রি খামার করতে পারেন।
এই ব্যবসা দেয়ার পূর্বে নিয়ম, মুরগীর রোগের বিভিন্ন বিষয় ও চিকিৎসা, লোক নিয়োগ প্রভৃতির জন্য প্রশিক্ষণ নেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া পোল্ট্রির পণ্য বাজারজাত করার বিষয়টিও আপনাকে বিবেবনা করে কাজ করতে হবে।
কেননা, পোল্ট্রির মুরগী ও ডিম সাপ্রাই করা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। সঠিকভাবে পোল্ট্রি ব্যবসা করে আপনি স্বাবলম্বী হতে পারবেন সহজেই ইনশা আল্লাহ্।
ছাদ কৃষি
অনেকের বাসাতেই রয়েছে বিশাল ছাদ। আপনার বাসায় যদি ছাদ থাকে; সেটা ছোট হোক, মাঝারি হোক অথবা বড় হোক – আপনি ছাদ কৃষি করতে পারেন।
অনেক মানুষই শখের কারণে ছাদে বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করে থাকেন। কিন্তু এই কাজ আরেকটু মনোযোগ ও যত্ন দিয়ে করলে এর মাধ্যমে কৃষি ব্যবসা সম্ভব।
ছাদে যদি আপনি প্রতিদিন ২ ঘন্টা যদি সময় ব্যয় করে কাজ করতে পারেন, তাহলে নিজের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত শাকসবজি বিক্রয় করে আয় করতে পারেন।
ছাদ কৃষির মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সাধারণত। কেননা, এতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়না। তাই আপনিও এই কৃষি ব্যবসাটি করতে পারেন।
ভেষজ ঔষধি গাছ
ভেষজ ঔষধি গাছের অনেক চাহিদা রয়েছে। আপনার যদি পর্যাপ্ত পরিমানে ভাল জমি থাকে, তাহলে বিভিন্ন ভেষজ ঔষধি গাছ রোপন করে সেগুলোর দ্বারা কৃষি ব্যবসা করতে পারেন। যেমনঃ হরিতকি গাছ।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ
মৎস্য গবেষকদের মতে, বায়োফ্লক এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়।
আর বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ বলতে, যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় অনেক পরিমান মাছ চাষ করা হয়, সেই পদ্ধতিকেই বায়োফ্লক বলা হয়।
এই পদ্ধতিতে মাছ যেখানে চাষ করা হয়, সেটার পানি বারবার পরিবর্তন করা যায় না। বিশেষ পদ্ধতিতে অল্প জায়গাতে অনেক মাছ চাষ করা যায়।
এর ফলে ব্যাপক পরিমাণে লাভবান হওয়া সম্ভব। তবে পর্যাপ্ত অর্থ নিয়ে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনাকে এই লাভজনক কৃষি ব্যবসা তে নামতে হবে। কেননা, কোন একটি ভুলের কারণে বিপুল লাভের মতো বিপুল ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে।
তবে নিয়ম মেনে সঠিকভাবে করতে পারলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে ব্ডাপক সাফল্য পাবেন ইনশা আল্লাহ্।
মাছ ও হাঁস-মুরগির সমন্বিত চাষ
অনেকেই শুধু মাছ চাষ করেন। আবার অনেকে শুধু হাঁস-মুরগি পালন করেন। অথচ এই ২টি কে সমন্বিতভাবে পালন করে ভাল পরিমানে আয় করা সম্ভব।
আপনি যদি পুকুরে মাছ চাষ করে থাকেন, তাহলে সে পুাুরের ওপর মাচা বেধে ঘর তৈরী করে সেখানে হাঁস-মুরগিও পালন করতে পারেন।
হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা হলো মাছের খাদ্য। এর জন্য আপনার মাছের জন্য খাদ্যখরচ কমে যাবে ইনশা আল্লাহ্। ফলে হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষ একত্রে করার মাধ্যমে ব্যাপক মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন ফলের চাষ
একটি ফলের দোকানে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার ফল বিক্রী হয়। এর চাহিদা ব্যাপক। বিভিন্ন পুষ্টিতে ভরপুর এসব ফল আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য দরকারি।
বেদানা, আপেল, কমলা, নাশপাতি, কলা সহ প্রভৃতি ফলের ব্ডাপক চাহিদা রয়েছে। এসব ফলের চাষ করার মাধ্যমে কৃষি ব্যবসা করতে পারেন।
রাজশাহীর আমের চাহিদার কথা আমরা প্রায় সবাই কমবেশি জানি। একবার ভেবে দেখুন, এরকম ব্যবসা করাটা কতটা লাভজনক।
আপনি সিজনাল বা মৌসুমী ফলের ব্যবসা করতে পারেন। এছাড়া বারমাসি ফল হিসেবে বিভিন্ন কলাও চাষ করতে পারেন। ঢাকার বিভিন্ন চায়ের দোকানে কলার প্রচুর চাহিদা লক্ষণীয়। তাই বিভিন্ন রকমের ফলের চাষ করতে পারেন।
নার্সারি করা
গার্ডেনিং অথবা বাগান করা – অনেকেরই শখের একটি কাজ। গ্রামে গাছ লাগিয়ে সুন্দর বাগান অনেক মানুষই করে থাকেন।
শুধু গ্রামেই নয়; বরং শহরেও গার্ডেনিং এবং বৃক্ষরোপণ করে থাকেন অনেকেই। শহুরে জীবনে নগরায়ণের ক্ষতিকর দিক হলো বনারণ্য কেটে দালানকোঠা নির্মাণ করা।
এগুলো স্বাস্থ্যকর জীবনের পরিপন্থী। এসব বিষয়ে অনেক সচেতন মানুষই রয়েছেন; যারা বাড়ির ছাদে, রেলিঙ অথবা বারান্দাতে নার্সারি বাগান করে থাকেন।
তাই গ্রামীন এবং শহুরে – দুই স্থলেই নার্সারির ভাল চাহিদা লক্ষ্যণীয়। তাই আপনি আপনার বাড়ির কিছু জায়গা ব্যবহার করে বিভিন্ন চারা নিয়ে নার্সারি করতে পারেন।
এর দ্বারা আপনি চারা বিক্রয়ের মাধ্যমে আয় করতে পারেন। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল সাইট এমনকি নিজে একটি ওয়েবসাইট খুলেও নার্সারির চারা বিা্রয়ের মাধ্যমে কৃষি ব্যবসা করতে পারেন।
যেকোনো দেশের জন্যই কৃষি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটির চাহিদা সর্বত্রই বিরাজমান। কৃষির রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা। এগুলোর সমন্বয়েই হলো কৃষি ব্যবস্থা।
কৃষি ব্যবস্থার এসব শাখা-প্রশাখা কে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনেকেই অনেক সাফল্য লাভ করেছে।
তাই আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং মূলধন বিনিয়োগ করে কৃষি ব্যবসা করতে পারেন।
সফলতা অর্জনের জন্য কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রেখে আপনাকে কাজ করতে হবে। সেগুলো হলো – সততা, ধৈর্য্য, বিশ্বস্ততা এবং কঠোর পরিশ্রম। এই বিষয়গুলো মেনে কৃষি ব্যবসা করলে, মাসে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন অসম্ভব নয়।