ইসলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব

হাফেয মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম উখিয়াভী

সিনিয়র মুহাদ্দিস জামেয়া ইসলামিয়া বাইতুল কারীম হালিশহর চট্টগ্রাম।

আষাঢ় মানে বর্ষার রিমিঝিম বৃষ্টি, গুড়ি বৃষ্টির মধ্যদিয়ে বর্ষার আগমন। বর্ষায় প্রাকৃতি যেন নতুন রূপে সাজে। নতুন রূপে সাজানোর লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গৃহীত কর্মসূচীর আলোকে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপন কর্মসূচী পালন করে থাকে।এ কর্মসূচীর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের বন বিভাগ নার্সারীগুলোকে নিয়ে বৃক্ষ মেলার আয়োজনসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মানুষকে উৎসাহ প্রদান করে থাকে।

বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য।
এই পৃথিবীকে প্রাণীকুলের জন্য বসবাসযোগ্য করেছে বৃক্ষ। বৃক্ষ না থাকলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ত। পৃথিবী থেকে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে এবং অক্সিজেন দিয়ে এই বৃক্ষই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ শতাংশই বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের কল্পনা করা অবান্তর। ইসলাম সঙ্গত কারণেই পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে উদসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছে।
সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ঘোষণা করেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি গাছের চারা লাগায় অথবা বীজ রোপন করে, অতপর সেই গাছ ও ফসল দ্বারা কোনো মানুষ উপকৃত হয় কিংবা পশুপাখি ভক্ষণ করে, এর বিনিময়ে তার আমলনামায় সদকার সওয়াব লিখিত হয়।’

মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ শ্যামল বনভূমির মাধ্যমে সুশোভিত সৌন্দর্য্যমন্ডিত করেছেন। বৃক্ষরোপণকে ইবাদতের সমতুল্য ঘোষণা করে ইসলাম যে শান্তির ধর্ম তা বাস্তবে রূপায়নের চমৎকার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত আছে একটি হাদিস, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে বললেন, আমার ভাই চাষ করে আর আমি জিকির করি ও খাই। মহানবী (সা.) বললেন ‘তোমার চেয়ে তোমার ভাই বেশি আবেদ।’ এই নশ্বর পৃথিবীতে মুমিনের একমাত্র লক্ষ্যই হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। বেশি বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। গাছ লাগানো আমাদের প্রিয় নবিজী (সা.) এর অতি পছন্দনীয় একটি কাজ ছিল।

বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতি নিয়ে কুরআনের বর্ণনা
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কুরআনে উদ্ভিদ সম্পর্কে এরশাদ করেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সকল প্রকার উদ্ভিদ উদগত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি উদগত করি।’

এ আয়াতের মাধ্যমে পৃথিবীবাসী বৃক্ষরাজি যে কত বড় নিয়ামত তার প্রমাণ পায়। আবহমান কাল ধরে বৃক্ষরাজি মানুষের জীবন-জীবিকার উপাদান জুগিয়ে আসছে। একটি গাছ থেকে মানুষ, পশুপাখি, অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও বিশ্ব পরিবেশ বিভিন্ন ভাবে উপকৃত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার পক্ষে বৃক্ষের দান অপরিসীম।

সমগ্র বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় ও তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। এর সম্মুখভাগে রয়েছে বনায়ন। পৃথিবীটাকে সবুজ রাখতে আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইসলাম এ ব্যাপার বিজ্ঞানসম্মত ও সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রাণী জগতের বসবাস অনুকূলে পৃথিবী গড়ার উৎকৃষ্ট ভূমিকা পালন করছে। শুধু বৃক্ষরোপণ নয় বরং তা রক্ষাণাবেক্ষন বিষয়ে ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে।

বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহ ও নির্দেশনা
মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা যদি একটি ফলবান বৃক্ষরোপণ করে উহার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ কর, তাহলে তোমাদের দ্বারা বেহেশতে একটি ফলবান বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সমতুল্য হবে।’
গাছ মুসলমানদের সদকায়ে জারিয়ার অন্যতম উপকরণ। মুসলমানেরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে মৃত্যুই জীবনের চূড়ান্ত সমাপ্ত নয়, মৃত্যুর পরও অনন্ত একটা সময়ের সম্মুখীন হতে হয়। ইসলামে বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সদকায়ে জারিয়া বা অবিরত দান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করে তাহলে ওই গাছটি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ওই ব্যক্তির আমল নামায় সওয়াব লেখা হতে থাকবে।

প্রিয় নবিজী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় শুধু তিনটি ব্যতীত। আর তা হচ্ছে- (১) যদি সে কোনো সদকায়ে জারিয়া রেখে যায়, (২) এমন জ্ঞান রেখে যায় যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য মাগফিরাত কামনা করে। এই তিনটি ভালো কাজের ফল সে পেতে থাকবে।’

গাছপালা খাদ্য তৈরীর সময় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ হতে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। আর সমগ্র মানবকুল বায়ুমন্ডল হতে অক্সিজেন গ্রহণ করে। গাছ যদি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ত্যাগ না করতো তবে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যেত এবং প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যেত। এছাড়াও গাছ মানুষের জন্য খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ ও আসবাবপত্র তৈরি মূল্যবান উপকরণের জোগান তো দিয়েই থাকে। সুতরাং বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, যা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না।

জীবজন্তু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই তাই বৃক্ষরোপনণের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে রাহমাতাল লিল আলামিন ইরশাদ করেছেন, যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারোর হাতে একটি চারা গাছ থাকে তাহলে সে যেন সেই বিপদ সংকেট মুহূর্তেও তার রোপণ করে দেয়।

আমাদের করণীয়

সবুজ শ্যামল বিশ্বের মানচিত্র রক্ষার জন্য আজ আমাদের সামনে একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে আর তা হলো অধিক বৃক্ষরোপণ। বৃক্ষহীনতায় যেকোনো দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়। ফলে মানব জীবনে নানা সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়।

বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারের সঙ্গে জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই মহতী কাজে অংশীদার করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং বলা যায়, আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে সবুজের সমারোহ করতে সর্বস্তরের নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে ভূপৃষ্ঠে বৃক্ষের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বৃক্ষরাজি আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, গৃহস্থালি, আসবাবপত্র, ওষুধ, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভূত উপকার সাধন করে। এছাড়া বৃক্ষ ভূমি ক্ষয়রোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ, মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। তাই ইসলামে বৃক্ষরোপনের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
আমাদের সকলকে ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ এই স্লোগান বাস্তবায়ন করে বৃক্ষরোপণকে একটি সামাজিক আন্দোলন রূপে প্রতিষ্ঠা করে ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভে সচেষ্ট হতে হবে।

গাছ-বৃক্ষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ‘বন্ধু’। তাই নির্বিচারে গাছ না কেটে প্রচুর বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করি।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বৃক্ষরোপণের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন…

লেখক : সম্পাদক ‘‘আলোর খেয়া‘‘ হেফাজত সমাচার, খতমে নবুওয়াতের খবর।

Bangla-Alo

সম্পাদক & প্রকাশক : সোহেল রানা সর্বদায় সত্যের বাংলা আলো সব সময় আপনার মনের কথা প্রকাশের জন্য

Recent Posts

৫টি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের লিরিক্স

প্রতিটা দেশেরইই একক কিছু দেশাত্মবোধক গান থাকে তেমনি বাংলাদেশেও রয়েছে এমন অনেকগুলো দেশাত্মবোধক গান।  আমরা…

23 hours ago

ইসলামিক পদ্ধতিতে ওজন কমানো এবং সুস্থ থাকার উপায় জানুন

আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আল্লাহর রহমতে সবাই ভাল আছেন। আমাদের আজকের জানার বিষয় হলো -…

2 days ago

বেগুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানুন, নিজে চাষ শুরু করুন

আসসালামু আলাইকুম। আশা করি সবাই আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক ভালো আছেন। আজকে আপনাদের সাথে বেগুন চাষ…

2 days ago

ওমরা ভিসা করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত সকল তথ্য ২০২৪

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আশা করি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ও অশেষ রহমতে সবাই অনেক ভালো…

2 days ago

কনফেকশনারি ব্যবসার আইডিয়া || শুরু থেকে শেষ অব্দি

আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আল্লাহর ইচ্ছায় সবাই ভালো আছেন। আমাদের দৈনন্দিনের খাদ্য তালিকার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ…

2 days ago

মন ভালো রাখার উপায় || মন সুস্থ রাখার ১০ টি টিপস

মানুষের মন যেহেতু আছে এটা ভালো কিংবা খারাপ থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়।  একটা…

1 month ago